এই পোস্টটি 140 বার দেখা হয়েছে
![দামোদর লীলার রহস্য!](http://csbtg.org/wp-content/uploads/2023/11/tumblr_717f23e42509340e04057f25bdc38b1c_ab7a6f1b_2048.jpg)
ড. প্রেমাঞ্জন দাস, মায়াপুর, ভারত
এই পৃথিবীতে বিভিন্ন রকমের ধর্ম রয়েছে এবং বিভিন্ন ধর্মে ভগবান সম্পর্কে ধারণার মধ্যেও কিছু কিছু তারতম্য রয়েছে। যেমন: খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষেরা মনে করেন, ভগবান হচ্ছেন সকলের পিতা এবং তিনি একজন মহান ব্যক্তি। এইভাবে সব ধর্মের মধ্যে যথেষ্ট মিল রয়েছে আবার পাশাপাশি অনেক গরমিলও রয়েছে। কিন্তু বৈদিক সাহিত্যে এবং বিশেষ করে বৈষ্ণব সাহিত্যে ভগবান সম্পর্কে যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তা অতি ব্যাপক এবং যুক্তি সঙ্গত ও অতি অদ্ভুত। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে অন্যান্য ধর্মে ভগবানকে শুধু মহত্তম ও বৃহত্তম বলে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু বৈষ্ণব তথা বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ভগবান মহত্তম থেকে মহত্তর এবং ক্ষুদ্রতম থেকে ক্ষুদ্রতর। অনুর অনীয়ান, মহৎ মহীয়ান। অন্যান্য ধর্মে ভগবানকে মহত্তম বলে স্বীকার করা হলেও তিনি যে ক্ষুদ্রতম থেকেও ক্ষুদ্রতর হতে পারেন, সেই তত্ত্বটি অনুভূত হয়নি। দর্শন শাস্ত্রে তিন প্রকারের দর্শনের কথা শোনা যায় তত্ত্ব, বিপরীত তত্ত্ব এবং এই উভয়ের সমন্বয়। আমাদের বৈষ্ণব তথা সনাতন ধর্ম হচ্ছে এক প্রকার সমন্বয় তথা। এই সমন্বয় মনুষ্য দ্বারা তৈরী হয়নি, এটি স্বয়ং ভগবান কর্তৃক প্রদত্ত হয়েছে। এই জন্য আমরা দেখি যে, আমাদের সনাতন শাস্ত্রে সমস্ত পরস্পর বিরোধী ও বিপরীতমুখী লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্য ভগবানের মধ্যে একই সঙ্গে সহাবস্থান করছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ঈশোপনিষদের একটি শ্লোকে বলা হয়েছে,
তদ্ এজতি তন্নৈজতি তদ্দুরে তদ্বন্তিকে।
তদন্তরস্য সর্বস্য তদু সর্বস্যাস্য বাহ্যতঃ ॥
যার অর্থ হল তিনি চলেন, তিনি চলেন না। তিনি দুরের থেকেও দূরে, তিনি কাছের থেকেও কাছে। তিনি সব কিছুর অন্তরে অবস্থিত এবং সব কিছুর বাইরে অবস্থিত।
এই কারণেই সারা পৃথিবী জুড়ে বেশীর ভাগ মানুষ বুঝতে পারে না যে, কৃষ্ণ হচ্ছেন ভগবান। যদি কেউ কৃষ্ণলীলা পাঠ করেন, তাহলে অধিকাংশ মানুষ তাদের সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারেন না যে, কৃষ্ণ হচ্ছেন ভগবান। বেশীর ভাগ মানুষই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, কৃষ্ণ অবিবাহিত গোপীদের বস্ত্র হরণ করেছেন। কিংবা কৃষ্ণ যেমন পরস্ত্রীদের সাথে রাস নৃত্য করেছেন। এসব কথা শুনে সাধারণ বুদ্ধি সম্পন্ন কোন্ মানুষ বিভ্রান্ত না হবে! সাধারণ মানুষ অতি সহজেই বিভ্রান্ত হতে পারে। তাই বলা হয় যে, যেই জন কৃষ্ণ ভজে, সে বড় চতুর। একজন অতি বুদ্ধিমান ব্যক্তি যখন গুরু পরম্পরা ভুক্ত আচার্যদের টীকা পাঠ করেন এবং কৃষ্ণলীলার সুগভীর রহস্য বুঝতে পারেন, তখন তিনি আপাত বিরোধী এবং পরস্পর বিরোধী সমস্ত কৃষ্ণলীলার তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন। যেমন আমরা জানি যে ভগবান হচ্ছেন সর্বশক্তিমান। কিন্তু ভগবান আবার সবচেয়ে দুর্বল। তা কি করে সম্ভব? যিনি সর্ব শক্তিমান, তিনি কি করে অতি দুর্বল হবেন?
যশোদা নামের এক মহিলা কি করে সর্ব শক্তিমান ভগবানকে বেঁধে ফেলতে পারেন? আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে কৃষ্ণ এখানে খুব দুর্বল। তাহলে বেশির ভাগ মানুষ কি করে বুঝতে পারবে যে কৃষ্ণ হচ্ছেন ভগবান? এক মহিলা যাকে বেঁধে ফেলতে পারেন, তিনি কি করে সর্ব শক্তিমান ভগবান হতে পারেন? এই প্রশ্নের উত্তর হল এই যে, কৃষ্ণ নিশ্চয়ই সর্ব শক্তিমান ভগবান। কিন্তু ভগবানের যে প্রেম তথা কৃষ্ণপ্রেম, তা ভগবানের থেকেও অধিক শক্তিশালী। শ্রীমদ্ভাগবতে (১/২/৬) তাই বলা হয়েছে,
সবৈ পুংসাংপরো ধর্মো যতো ভক্তিরধোজে।
অহৈতুক্যপ্রতিহতা যয়াত্মা সুপ্রসীদতি ॥
সেই ধর্ম হচ্ছে মানুষের পরম ধর্ম যাতে মানুষ ইন্দ্রিয়াতীত ভগবানের প্রতি অহৈতুকী এবং অপ্রতিহত ভক্তিলাভ করে, যার দ্বারা মানুষের আত্মা সুপ্রসন্ন হয়।
তাই সিদ্ধান্ত হল যে প্রেম ভগবানকে পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে। একজন ভক্ত আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, “আপনারা বলেন যে কৃষ্ণ হচ্ছেন ভগবান, কিন্তু কখনো বা রাধারানী কিংবা মা যশোদা ভগবানকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তাহলে আপনারা তো যোগমায়াকে ভগবান বলতে পারেন।” এই প্রশ্নের উত্তর হল এই যে, যোগমায়া যে কৃষ্ণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন সেই নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কৃষ্ণ স্বয়ং যোগমায়াকে প্রদান করেন।
মায়াবাদীরা বলেন যে ভগবান মহামায়ার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হন। কিন্তু আমরা যারা সনাতন ধর্মাবলম্বী তথা বৈষ্ণব, আমরা বলি যে ভগবান যোগমায়ার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হন। মহামায়া শুধু সেই সব লোকদের নিয়ন্ত্রণ করেন যারা ভগবানের মতো ভোগ বিলাস করতে চায়।
কিন্তু যোগমায়া শুধু তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করেন যাঁরা প্রেমভক্তি সহকারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সেবা করার ইচ্ছা করেন। সেই কৃষ্ণপ্রেম হচ্ছে এক পরম পবিত্র বস্তু এবং যখন যোগমায়া সেই প্রেমকে নিয়ন্ত্রণ করেন তখন স্বয়ং ভগবানও সেই যোগমায়ার নিয়ন্ত্রণে থাকতে চান। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজের হাতে সেই প্রেমকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা ঢ়ড়বিৎ ড়ভ ধঃঃড়ৎহবু হিসাবে যোগমায়ার হাতে তুলে দেন। সেজন্যই যোগমায়ার ক্ষমতা তথা কৃষ্ণপ্রেমের ক্ষমতা সর্ব শক্তিমান ভগবান শ্রীকৃষ্ণের থেকেও বেশী। যারা সনাতন শাস্ত্রের এই সিদ্ধান্তটি বুঝতে পারেন না, তারা কখনোই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলারহস্য বুঝতে পারবেন না ।
মা যশোদা যেভাবে কৃষ্ণকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলেছেন, তা হল এই সিদ্ধান্তের একটি অতি চমৎকার দৃষ্টান্ত যা থেকে আমরা বুঝতে পারি, কিভাবে ভগবান প্রেমের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হন। এই লীলাতে আমরা দেখি যে ভগবান খুব দুর্বল। কিন্তু শ্রীল বিশ^নাথ চক্রবর্তী ঠাকুরের মতে এটি হচ্ছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের একটি সর্বোচ্চ গুণ। সর্ব শক্তিমান গুণটির থেকে তিনি যে প্রেমের কাছে দুর্বল, এই গুণটিই অধিক মহত্ত্বপূর্ণ।
যশোদা নামটির মধ্যে দুটো শব্দ রয়েছেঃ যশ এবং দা। দা মানে দান করেন। যিনি ভগবানকে পর্যন্ত যশ দান করেন তিনিই হলেন যশোদা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে মা যশোদা এক সর্বোত্তম যশ দান করেছিলেন, যা ভগবানের অন্য সকল যশকে পর্যন্ত হার মানায়। অর্থাৎ ভগবান সর্বশক্তিমান ইত্যাদি যশের থেকেও প্রেমের কাছে তাঁর দুর্বলতা অধিকতর মহত্ত্বপূর্ণ।
ভগবান সম্পর্কে এই যে ধারণা, তিনি যে ভক্তের প্রেমের বশীভূত, তা সনাতন ধর্ম ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মে এত সুস্পষ্টরূপে পাওয়া যায় না।
মা যশোদা কর্তৃক এই দাম বন্ধন লীলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল দীপাবলি মহোৎসবের তিথিতে। যদিও এই লীলা বৃন্দাবনে ভক্তদের সামনে আপাত বিচারে মাত্র এক দিন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু ভক্তরা আজও তা পরম উৎসাহের সঙ্গে এক মাস ধরে উদ্যাপিত করে। বৈষ্ণব পরম্পরার মহাজনগণ টানা একমাস ধরে মহোৎসবের অনুমোদন করেছেন যাতে ভক্তরা ভগবান যে প্রেমের বশীভূত, ভগবানের এই সর্বোচ্চ গুণটির মহত্ব গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারে। এ থেকেই এই লীলার গুরুত্ব কিছুটা অনুধাবন করা যায়।