পদ্মপুরাণে বর্ণনা করা হয়েছে যে, ভগবানের প্রীতিসাধনের নিমিত্ত যেকোনো কার্যই অন্যান্য সাধারণ দিনগুলির চেয়ে এই দামোদর মাসে শতগুণে মঙ্গল প্রদান করে। ভগবান দামোদরকে সন্তুষ্ট করার জন্য নির্দিষ্ট কার্য সম্পাদনের মাধ্যম তাঁর কৃপা লাভের কোনো তুলনা চলে না।
ভগবান দামোদর অপরাজেয়। কিন্তু তিনি পরাজিত হয়েছিলেন তাঁর মাতার প্রেমের দ্বারা। এই বার্তাটিই দামোদর মাস স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে যে, মা যশোদা দামোদরকে তাঁর সন্তান ভেবে বাঁধতে চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বুঝতে পারেননি যে দামোদর হচ্ছেন অসীম, পরমেশ্বর ভগবান। আর তাই তিনি তাঁকে বার বার বাঁধতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু প্রতিবারই দড়িটি দু’আঙুল ছোট হয়ে যাচ্ছিল। এই দুটি আঙুলের অর্থ কী? একটি হল শুদ্ধভক্তের আকাঙ্ক্ষা এবং দ্বিতীয়টি হল পরমেশ্বর ভগবানের অহৈতুকী কৃপা। মা যশোদার বাসনাটি ছিল শুদ্ধ আর কৃষ্ণ যখন সম্মত হলেন তিনি বাঁধা পড়লেন। কৃষ্ণের সম্মতি বিনা কেউই তাঁকে বাঁধতে পারে না। সুতরাং তিনি তাঁর মায়ের প্রেমের দ্বারা বিজিত হয়েছিলেন । দামোদর মাসে এই বার্তাটিই আমরা লাভ করি। সুতরাং সাধারণ মানুষের কাছেও ভগবানের কৃপা লাভের এটি একটি সুযোগ। দামোদর মাসের গুরুত্বের কথা হরিভক্তি বিলাস, ভক্তিরসামৃতসিন্ধু ও আরও নানা গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষ কিছুই আপনাকে করতে হবে না। ভগবানের কাছে দীপ নিবেদন করুন, অর্ঘ্য নিবেদন করুন এবং প্রার্থনা নিবেদন করুন, তাহলেই হবে। এই সমস্ত সাধারণ জিনিসগুলিই আমরা করে থাকি। দামোদর ব্রতের কথা এমনভাবে আমরা প্রচার করেছি যে, আমরা অনেক গৃহে ভগবান দামোদরের ছবি প্রদান করেছি এবং মানুষ তাদের গৃহে দামোদরের ছবির সামনে আরতি নিবেদন করছে। ভগবান দামোদরের কাছে কোনো প্রার্থনা করার কথাও আমরা তাদের বলছি। এভাবে সাধারণ মানুষ ভগবানের অসীম কৃপা লাভ করছে। শ্রীকৃষ্ণ ভগবদ্গীতায় বলেছেন যারা মানুষকে তাঁর ভক্তিপূর্ণ সেবায় নিয়োজিত করার জন্য যুক্ত রয়েছেন, সমস্ত ভক্তদের মধ্যে তাঁরা সবচেয়ে প্রিয়। তাই এইভাবে দামোদর মাসে মানুষকে ভগবানের সেবায় নিযুক্ত করে আমরা কৃষ্ণের অত্যন্ত প্রিয় হয়ে উঠছি।
আমার মনে আছে, একবার পাশ্চাত্যের ইকুয়েডর দেশের গুয়াকুইল শহরে ‘সিটি হল’ নামক সভাগৃহে আমরা প্রায় তিন/চারশত মানুষ একটি কৃষ্ণভাবনামৃত অনুষ্ঠানে সমবেত হয়েছিলাম। তখনও ছিল দামোদর মাস। তাই সেখানে ভগবান দামোদরের একটি ছবি ছিল, সামনে এক থালা ভর্তি বালি ছিল আর সেখানে ছিল অনেক মোমবাতি। আমরা যেহেতু সেখানে ঘিয়ের বা তিল তেলের প্রদীপ জ্বালাতে অপারগ ছিলাম, তাই আমরা মোমবাতি জ্বালিয়েছিলাম । আমরা যখন সমবেত মানুষকে ভগবান দামোদরের কাছে তাদের দীপ নিবেদন করতে বললাম, যদিও তারা ছিল মূলত অন্য ধর্মাবলম্বী এবং তাদের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না যে, ঠিক কীভাবে ভগবান দামোদরের কাছে আরতি নিবেদন করতে হয় কিন্তু তবুও তারা উৎসাহের সঙ্গে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিল এবং একে একে দামোদরের কাছে দীপ নিবেদন করেছিল। এই সেবাটি করে তারা অত্যন্ত আশীর্বাদধন্য বলে নিজেদের মনে করেছিল। তাই আমার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা রয়েছে যে, এই সেবা ঠিক কীভাবে অংশগ্রহণকারীকে পরম আনন্দ দান করে।
মায়াপুরেও, ভক্তরা ছাড়াও, দর্শনার্থীদের সবাইকে দীপ দান করার জন্য অনুরোধ করা হয় এবং এই বিশেষ মাসটিতে সহস্র সহস্র দর্শনার্থীর ভীড় হয়। তাঁরা সকলেই রাধারানি এবং মা যশোদা ও দামোদরের ছবিতে এবং বিভিন্ন বিগ্রহকে ঘিয়ের সলতের দীপ এই মাসে বিশেষভাবে নিবেদন করে থাকেন।
তাই মানুষকে ভক্তিসেবায় যুক্ত করার জন্য এমনভাবে আচরণ করা উচিত যাতে তারা যেন কখনও কৃষ্ণকে ভুলে না যায়। তাই আমি আশা করব, ভক্তগণ এই সেবাটি অত্যন্ত উৎসাহের সাথে গ্রহণ করবে।
মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর ইসকন মন্দিরের শ্রীউত্তম চৈতন্য দাস ধীরে ধীরে সেখানে এই অনুষ্ঠানটি প্রধানভাবে গড়ে তুলেছিল। দামোদর মাসটি যে কতখানি চমৎকার সে বিষয়ে বিভিন্ন শাস্ত্র থেকে সে বিভিন্ন উদ্ধৃতি সংগ্রহ করেছিল। কিন্তু আমাদের কাছে এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে, সে সহসা ভগবদ্ধামে ফিরে গেছে। এখন আমরা আশা করব যে, দামোদর মাসের প্রতি তাঁর নিষ্ঠাপূর্ণ কর্মধারাকে স্মরণ করে আমরা আরও বড় ভাবে এবং আরও বর্ণাঢ্য মহিমার মধ্য দিয়ে সেসাথে নতুন নতুন চিন্তার মধ্য দিয়ে প্রতি বৎসর এই দামোদর মাসে সাধারণ মানুষকে কৃষ্ণের সেবায় নিয়োজিত করব। দামোদর মাসে যারা এই ব্রত বা সেবায় যুক্ত থাকে আমরা যদি তাদের সকলের সঙ্গে যোগাযোগ বা সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি, তাহলে তাদেরকে আমাদের সঙ্ঘবদ্ধ প্রচারের অংশ করে তুলতে ও সামগ্রিকভাবে সবকিছু পরিচালনা করলে দামোদর ব্রতের ব্যাপারটি আরও সহজ হবে।
অতএব দেখা যায় যে, এইভাবে পবিত্র দামোদর মাসের কার্যাবলীসমূহ অত্যন্ত সহজ, বিনম্র ও অত্যন্ত কার্যকরী। তাই আশা করা যায় যে, প্রত্যেকেই এই দামোদর মাসকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করবে। সকলকে অনেক ধন্যবাদ।