এই পোস্টটি 59 বার দেখা হয়েছে
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নামে উৎসর্গীকৃত দক্ষিণ ভারতের এক অনন্য তীর্থস্থান ভ্রমণ
চন্দনযাত্রা দাস
গুরুবায়ুর যেটি “দক্ষিণ ভারতের দ্বারকা” নামে সুখ্যাত, এখানে রয়েছে পৃথিবী বিখ্যাত গুরুবায়ুর শ্রীকৃষ্ণ মন্দির। গুরুবায়ুর শ্রীকৃষ্ণকে স্নেহভরে ডাকা হয় “শ্রী গুরুবায়োেরাপ্পান নামে”। এই বিগ্রহটি প্রতিষ্ঠা করেন স্বয়ং দেবগুরু বৃহস্পতি এবং বায়ু। শ্রীগুরুবায়োেরাপ্পান হলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চতুর্ভূজরূপী বিগ্রহ, যার চার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম শোভা পাচ্ছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই রূপ প্রদর্শন করেছেন দুইবার। প্রথমবার তাঁর পিতা-মাতা দেবকী ও বসুদেবকে মথুরায়, ঠিক যখন তিনি মর্ত্যলোকে আবির্ভূত হয়েছিলেন দ্বিতীয় বার বৃন্দাবন থেকে মথুরায় আসার পথে অক্রুরকে যমুনাতে স্নান করার সময় এই রূপ দর্শন প্রদান করেছিলেন। এরপর যখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পৃথিবীতে তাঁর লীলা সমাপন করতে চাইলেন, তখন কৃষ্ণ তাঁর অনুগত উদ্ধবকে এই বিগ্রহটির ভার অর্পণ করলেন। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধবকে ভবিষ্যতবাণী শোনালেন, তিনি চিন্ময় জগতে প্রত্যাবর্তন করার ৭ দিন পর দ্বারকা সমুদ্রের জলে জলমগ্ন হবে। ভগবান তাকে নির্দেশ দিলেন তাঁর এই চতুর্ভুজ বিগ্রহ যেটি স্বয়ং দেবকী-বসুদেব সেবা করেছেন সেটি যেন দেবগুরু বৃহস্পতিকে প্রদান করা হয়। ভগবানের ভবিষ্যতবাণী অনুসারে ৭ দিন পর দ্বারকা জলমগ্ন হল এবং উদ্ধব যখন অত্যন্ত দুঃখিত চিত্তে সমুদ্রের তীরে গমন করলেন তখন তিনি জলের মধ্যে কিছুটা দূরে এই বিগ্রহকে ভাসতে দেখলেন। কিন্তু ঝড়ো বাতাসের কারণে বিগ্রহটি ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিল। তখন উদ্ধব বায়ুদেবের কাছে প্রার্থনা করলেন তিনি যেন সেই বিগ্রটিকে তাঁর কাছে নিয়ে আসেন। এরপর বায়ুদেব সেই বিগ্রটিকে নিয়ে আসলেন, উদ্ধব বিগ্রহটি পেয়ে স্নেহভরে জড়িয়ে ধরলেন। কিন্তু যখনই তিনি ভাবলেন কিভাবে এই বিগ্রটিকে দেবগুরু বৃহস্পতির কাছে পৌঁছানো যায় ঠিক সেই মুহুর্তে বৃহস্পতি সেখানে উপস্থিত হলেন। তখন উদ্ধব ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদেশের কথা জানালেন যদিও বৃহস্পতি তা পূর্ব থেকেই জানতো। এরপর দেবগুরু বৃহস্পতি সেই বিগ্রহকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটি উপযুক্ত স্থানের সন্ধান করার মনস্থির করলেন। তিনি বায়ুদেবকে আদেশ করলেন তাকে যেন সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়, যাতে তিনি বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি উপযুক্ত স্থানের সন্ধান লাভ করতে পারেন।
সে বিগ্রহটিকে হাতে নিয়ে বৃহস্পতি সমগ্র ভারতবর্ষ ঘুরলেন। অবশেষে বর্তমান গুরুবায়ুর শহরে এনে বিগ্রহটিকে প্রতিষ্ঠা করলেন। বৃহস্পতি সেখানে দেখলেন একটি সুন্দর হ্রদ রয়েছে যেখানে পদ্ম ফুলের সমাহার এবং শিব ও পার্বতী সেখানে নৃত্য করছেন। এই দৃশ্য দেখে দেবগুরু বৃহস্পতি মুগ্ধ হয়ে বায়ুদেবকে নির্দেশ দিলেন, সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যখন শিব-পার্বতী তাদের অপ্রাকৃত নৃত্য সমাপন করলেন তখন বৃহস্পতি ভগবান শিবের কাছে প্রার্থনা জানালেন বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি উপযুক্ত স্থানের বার্তা দেওয়ার জন্য। তখন তিনি জানালেন এই স্থানটিই হলো আদর্শ স্থান। ভগবান শিব নির্দেশ দিলেন এখানেই ভগবান কৃষ্ণের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হোক এবং আমি ও পার্বতী হ্রদের অন্য পাশে প্রস্থান করবো এবং সেই স্থানটিও রুদ্র তীর্থ নামে প্রসিদ্ধ হবে।
যতই সময় অতিবাহিত হবে হ্রদের জল তত শুকাতে থাকবে। বর্তমানে মন্দিরের সন্নিকটে কেবল একটি ছোট পুষ্করিণী রয়েছে। ভগবান শিব যেখানে প্রস্থান করেছিলেন সেই মন্দিরটির নাম মহিমায়ুর। তাই মহিমায়ুর মন্দির দর্শন ব্যতীত গুরু বায়ুর দর্শন সম্পূর্ণ হয় না। গুরু (বৃহস্পতি) এবং বায়ু এই বিগ্রহটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাই এই স্থানের নাম করণ করা হয় শিবের ইচ্ছায় ‘গুরু বায়ুর’। মন্দিরটি তৈরি করেন দেব শিল্পী বিশ্বকর্মা তিনি এমনভাবে এটি নির্মাণ করেন যেন সূর্যের প্রথম রশ্মি ভগবানের পাদপদ্ম স্পর্শ করে।
জন্মেজয় পিতা পরীক্ষিত মহারাজের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সর্প ধংস যজ্ঞ করেন। এই যজ্ঞে হাজার হাজার নিরীহ সর্প মৃত্যু বরণ করে। সেই নিরাপরাদ সর্পদের অভিশাপের কারণে তার কুষ্ঠ রোগ হয়। তার সেই দুর্দশা থেকে তাকে মুক্ত করার জন্য ঋষি দত্তাত্রেয় সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি জন্মেজয়কে আদেশ দিলেন, “যাও গুরু বায়ুরে গিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর।” তখন জন্মেজয় সেই বিগ্রহের মাহাত্ম্যের কথা জানার অভিলাষ করেন। তখন ঋষি দত্তাত্রেয় নারদ পুরাণ থেকে এই বিগ্রহের লীলা বর্ণনা করেন।
পদ্ম কল্পের শুরুতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই বিগ্রহটি ব্রহ্মাকে প্রদান করেন যাতে ব্রহ্মাজী তাঁর সৃষ্টিকার্য সুষ্টভাবে সুসম্পন্ন করার জন্য এই বিগ্রহের আরাধনা করতে পারেন। বরাহ কল্পে সুতপা ও পৃশ্নি দম্পতী, যাদের কোনো সন্তান ছিল না, তারা ব্রহ্মার কাছে পুত্র লাভের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা জানান। ব্রহ্মা তাদের আরাধনা করার জন্য এই বিগ্রহটি প্রদান করেন। কিছু সময়কাল বিগ্রহটি আরাধনা করার পর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সুতপা ও পৃশ্নিকে বর প্রদান করলেন। সেই
বরটি ছিল কৃষ্ণ নিজেই তাদের পুত্র রূপে আবির্ভূত হবেন। কৃষ্ণ পৃশ্নিগর্ভা, বামন এবং স্বয়ং কৃষ্ণ রূপে তিনবার তাদের পুত্র রূপে আবির্ভূত হন। প্রতি জন্মেই সুতপা ও পৃশ্নি এই বিগ্রহের আরাধনা করেন। যখন কৃষ্ণ নিজেই আবির্ভূত হন সেই সময় বসুদেব ও দেবকী দ্বারকা মন্দিরে একশত বছর এই বিগ্রহের সেবা
পূজা করেন।
গুরু বায়ুর শ্রীকৃষ্ণের মহিমা শ্রবণ করার পর জন্মেজয় গুরু বায়ুর মন্দিরে অবস্থান পূর্বক ভক্তিমূলক তপস্যা করেন। এক রাত্রিতে যখন তিনি ঘুমাচ্ছিলেন তখন তিনি তার শরীরে ভগবানের স্পর্শ অনুভব করলেন এবং তৎক্ষণাৎ সমস্ত যন্ত্রণা দূরীভূত হল। তিনি ভগবানের গুণমহিমা কীর্তন করতে করতে তার রাজ্যে ফিরে গেলেন। প্রচেতাগণও গুরু বায়ুরে এসে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে কঠোর তপস্যা করেন। তাদের অভিলাষ পূরনার্থে ভগবান শিব রুদ্র তীর্থে আবির্ভূত হন এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মহিমা সূচক রুদ্রগীত তাদের শ্রবণ করান। প্রচেতাগণ সেই রুদ্র তীর্থে ১০ হাজার বছর যাবৎ সেই রুদ্রগীত জপ-কীর্তন করেন এবং পরিশেষে তারা সকলেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৃপা আশীর্বাদ লাভ করেন। পরে তারা বিবাহ করেন এবং তাদের পুত্র রূপে প্রজাপতি দক্ষ আবির্ভূত হলেন। এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানা যাবে শ্রীমদ্ভাগবতের ৪ স্কন্ধের ৩০ নং অধ্যায়ে।
গুরু বায়ুর শ্রীকৃষ্ণের মন্দির ভুলোকের বৈকুণ্ঠ নামে সুপরিচিত। এটি ভারতের অন্যতম মহিমান্বিত মন্দির। এখানে (কেরেলা) আসলে মানুষের মুখে মুখে, “কৃষ্ণ, কৃষ্ণ, গুরু বায়ুরাপ্পান” ধ্বনি শোনা যায়। এখানের প্রতিটি ঘরে এবং মানুষের হৃদয়ে রয়েছে গুরু বায়ুর এর প্রতি অগাধ ভালোবাসা। বিভিন্ন বিখ্যাত ভক্ত যেমন, বিল্বমঙ্গল ঠাকুর (শ্রীকৃষ্ণকর্ণামৃত গ্রন্থের রচয়িতা), পুনথানাম (শ্রীগুরু বায়ুর রাপ্পানের শুদ্ধ ভক্ত) এখানে নিয়মিত ভগবানকে দর্শন করতে আসতেন। গুরু বায়ুর ত্রিশূর থেকে ৩০ কিলোমিটার এবং কোচি থেকে ৮০ কি.মি দূরে অবস্থিত। ইস্কনের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য, ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ ১৯৬৫ সালের ২০ আগষ্ট ৬৯ বছর বয়সে এই কোচি শহরে আগমন করেন। পাশ্চাত্য জগতে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের উদ্দেশ্যে আমেরিকা ভ্রমণের জন্য জলদূত জাহাজে পদার্পণ করেন।
গুরু বায়ুরের বিভিন্ন তীর্থ স্থান সমূহ
১. গুরু বায়ুর শ্রীকৃষ্ণের মন্দির
২. শ্রীপার্থ সারথি মন্দির
৩. পূর্ণাতুর কোট্টা
৪. তিরু ভঙ্গকটাচলাতি মন্দির
৫. দক্ষিণ বৃন্দাবন-কায়পরন্তু ইস্কন মন্দির
৬. নেনমিনি শ্রী বলরাম মন্দির
৭. মহিমায়ুর মন্দির
৮. মঙ্গনচিরা বিষ্ণু মন্দির (পেরুভালুর)
৯. ইস্কন গুরুবায়ুর (গুরুবায়ুর ইস্কন মন্দিরের সন্নিকটে)
১০. পুণ্যাথনম্ শ্রীকৃষ্ণ মন্দির এবং পুণ্যাথনম্ ইলম (গুরুবায়ুর থেকে ৬৫ কি.মি দূরে)
১১. ইস্কন কোচি
১-গুরু বায়ুর ইস্কন মন্দির
গুরুবায়ুর হলো সমগ্র ভারতের প্রতিদিন উপস্থিত ভক্ত সংখ্যার ভিত্তিতে চতুর্থ বৃহত্তম মন্দির। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করার জন্য প্রতি বছর এখানে ৭০ লক্ষ তীর্থযাত্রীর আগমন ঘটে। ভোর ৩ টায় নির্মলা দর্শনের মাধ্যমে মন্দিরের কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর রয়েছে ভগবানে অভিষেক। দুপুর ১টা থেকে বিকাল ৪:৩০ মিনিট পর্যন্ত মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকে। পুনরায় ৪:৩০ মিনিট এ মন্দির খোলা হয় এবং রাত ১০ টা পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে। এরপর বিগ্রহ বিশ্রাম নিতে শুরু করে। সমগ্র দিন ব্যাপী মন্দিরের পুরোহিতরা এবং হাজার হাজার ভক্তগণ নানামুখী কৃষ্ণভাবনাময় সেবায় যুক্ত থাকে। বিশেষত প্রতিদিন গুরুবায়ুরের উদ্দেশ্যে সংগীত ও ভজন গাওয়া হয়। এছাড়াও ভগবানকে সুন্দর সিলকের পোশাক পড়ানো হয় যা অত্যন্ত মূল্যবান। এছাড়াও ভগবানকে মূল্যবান গয়না পুষ্পমাল্য এমনকি হাতীও দান করা হয়। প্রতিদিন শ’খানেক ভোগ দ্রব্য নিবেদন করা হয়। সকাল বেলায় এখানে বিভিন্ন বিবাহ যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ ভারতের বেশিরভাগ দম্পতি ভগবানের আশীর্বাদ লাভের উদ্দেশ্যে এখানে বিবাহ সম্পন্ন করে। এখানে নৃত্য শিল্পীগণ ভগবানের লীলা বিষয়ক নৃত্য ও নাটিকা প্রদর্শন করেন। বিখ্যাত নৃত্য সমূহের মধ্যে রয়েছে কৃষ্ণোত্তম ও কথাকলি যা সাধারণত সন্ধ্যায় পরিবেশিত হয়। প্রতিদিন নৃত্যের বিশেষত্ব হলো এই মন্দিরের হাজারো বছরের ঐতিহ্য।
সন্ধ্যায় শোভাযাত্রা:
সমগ্র দিনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় সময় হলো সন্ধ্যায় হাতির পৃষ্ঠে চড়ে ভগবানের নগর ভ্রমণ। এই সময় ভগবানের বিগ্রহের অপূর্ব রূপ এবং সেই সুসজ্জিত হাতির দৃশ্য হাজার হাজার তীর্থযাত্রীকে আকর্ষিত করে। আর এই অনুষ্ঠানটি দর্শন করার জন্য প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হয়। বিগ্রহ পুনরায় ফিরে আসার সময় মন্দিরের পুরোহিতরা বিচিত্র প্রকারের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রয়েছে একটি উৎসব বিগ্রহ। যেটি সোনার সিংহাসনে বসে হাতির উপরে উঠে নগর পরিক্রমায় যান। এই সময় তার আশেপাশের ভক্ত পুরোহিতদের হাতে থাকে নানা রঙ বেরঙের ছাতা এবং বিভিন্ন রকমের চামর। এ সময় বাদকেরা বাদ্য যন্ত্র বাজায় এবং ভক্তগণ হরে “কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।” জপ করতে থাকে। ভগবানকে দশ হাজার ঘৃত প্রদীপ প্রজ্জলনের মাধ্যমে বরণ করা হয়। এক ঘন্টা শোভা যাত্রা শেষে হাতি মন্দিরে ফিরে আসে। যেহেতু এই হস্তী শোভাযাত্রা প্রতিদিন রাতে হয় তাই গুরুবায়ুর মন্দিরে রয়েছে একটি হাতিশালা। যেখানে ৬৫ টির ও বেশি বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হাতি রয়েছে যারা ভগবানের বিভিন্ন মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। এই মন্দিরের ইতিহাস পর্যলোচনা করলে আমরা কিছু বিশেষ হাতির কথা জানতে পারি। মন্দিরের বাইরের আংটি সদৃশ কাঠামোটি তৈরি করেছেন বিখ্যাত রাজা মানদেব বর্মা। তিনি কেরেলার ঐতিহ্যময় নকশায় মন্দিরের বহির্ভাগ তৈরি করেন। মন্দিরের ঐতিহ্য অনুযায়ী সমস্ত প্রকারের পূজা অর্চনা সুস্মপন্ন করেন নামভদ্রী ব্রাহ্মণেরা। এমনকি তারা মন্দিরেই বসবাস করতে পারে। এই মন্দিরের একটি বিশেষ দান হলো তুলাবরাম অর্থাৎ নিজের দেহের ওজনের সম পরিমাণ বস্তু ভগবানের উদ্দেশে দান করা।
কৃষ্ণনাট্যম্
এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে নৃত্য পরিবেশিত হয়। এই কৃষ্ণ নাট্যম্ হলো গুরুবায়ুর মন্দিরের একটি অদ্বিতীয় শিল্প। যা পৃথিবীর আর কোথায়ও দেখা যায় না। এটি কথকলির নৃত্যের পূর্ববর্তী শিল্প তাই এর পোশাক সমূহ কথকলি নৃত্যের মতো। এই নৃত্যের মাধ্যমে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দশটি লীলা প্রদর্শন করা হয়। এই লীলাগুলো বিশেষভাবে রচনা করেছেন ১৪শত শতকের রাজা মানদেব বর্মা। কৃষ্ণনাট্যম্ প্রতিদিন সন্ধ্যায় পরিবেশিত হয়। শুধুমাত্র বছরে জুলাই মাসে এটি স্থগিত থাকে। এই মন্দিরের এই বিশেষ নৃত্যটি প্রদর্শনের জন্য পূর্ব থেকে বুকিং করতে হয় এবং নৃত্যটি মন্দিরের বাইরে খোলা মাঠে প্রদর্শিত হয় যাতে সবাই দর্শন করতে পারে।
চতুর্বিলাক্ত বা দীপ প্রজ্জলন
এটি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান যা প্রতিদিন সন্ধ্যায় হয়ে থাকে। মন্দিরের সমস্ত দেওয়ালে ঘৃত প্রদীপ প্রজ্জলন করা হয়। এর ফলে প্রতি সন্ধ্যায় সমগ্র মন্দির প্রদীপে আলোকিত হয়ে উঠে। এখানে ভগবানের ভোগদ্রব্য যেগুলো দর্শনার্থীরা প্রসাদ হিসেবে লাভ করে থাকে তা হলো, পাল পায়াসাম (দুগ্ধজাত খাবার), কলা, এবিল (অন্ন), চন্দন, মাখন, উন্নিয়াপাম্স, মিষ্টি কলার বল। সন্ধায় পূজা শেষে ভগবানের প্রসাদ ভক্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়। সন্ধ্যায়
শোভাযাত্রায় যখন ১০ হাজার ঘৃত প্রদীপ জ্বালানো হয়, তখন এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। গুরুবায়ুর মন্দির প্রতিষ্ঠার ৫ হাজার বছর অতিবাহিত হয়েছে। এর মাঝামাঝি সময়ে বিভিন্ন প্রকারের দুর্দশা এসেছে। বিভিন্ন সময়ে সম্পদশালী রাজাগণ ভগবান গুরুবায়ুরকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্পণ করতো। সে সময়ে গুরুবায়ুর মন্দির ছিল একটি ছোট গ্রাম, যেখানে সুবিস্তৃত ফসলী জমি ছিল। ছিল হাজার হাজার গাভী এবং এক হাজার হাতি। কিন্তু এরপর যখন দক্ষিণ ভারতে টিপু সুলতানের রাজত্ব শুরু হয় তখন মন্দিরের অধিকাংশ স্থান জালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু যতই দুর্দশা আসুক না কেন ভগবান গুরুবায়ুরের কৃপায় মন্দিরটি সর্বদাই টিকে ছিল এবং তার গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য নিয়ে জাগ্রত হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে যখন বৃটিশ শাসনের অবসান হয় তখনও গুরুবায়ুরের কোনো প্রকার পৃষ্ঠপোষকতা ছিল না। কিন্তু তথাপিও এই মন্দির অগ্রগতি করেছে এবং এটি বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় মন্দির। ভোর ৩ টায় মন্দির খোলার আগেই আগেই হাজার হাজার ভক্ত উপস্থিত থাকেন ভগবানকে দর্শনের জন্য। সমগ্র দিনের বিভিন্ন সময় ভোগ, পোশাক, অভিষেক নিবেদন করা হয়। তবে এখানের একটি বিশেষ দিক হলো এক হাজার নারিকেল উৎসর্গ করা এবং ঘৃত প্রদীপ প্রজ্জ্বলন একটি আশ্চর্যের ব্যাপার, কেননা হাজার হাজার বছর ধরে এই ঐতিহ্য এখনো অব্যর্থভাবে পালিত হয়ে আসছে। আগামী সংখ্যায় গুরুবায়ুর যাত্রার আরো চমকপ্রদ তথ্য উপস্থাপন করা হবে। চলবে…
ব্যাক টু গডহেড অক্টোবর – ডিসেম্বর ২০১৮ হতে প্রকাশিত