তিনটি দড়ি আপনাকে বেঁধে রেখেছে (শেষ পর্ব)

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ৯:৩৩ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ৯:৩৩ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 263 বার দেখা হয়েছে

তিনটি দড়ি আপনাকে বেঁধে রেখেছে (শেষ পর্ব)

গত পর্বে আমরা তিনটি গুণের লক্ষণ ও কার্যকলাপ সম্পর্কে বিস্তৃত তুলে ধরা হয়েছিল। এ সংখ্যায় এ সম্পর্কিত আরো তথ্য তুলে ধরা হলো। তবে বিশেষভাবে এ প্রতিবেদনে কিভাবে এ তিনটি দড়ি বা গুণ থেকে আমরা মুক্ত হতে পারি সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হলো নিজেদেরকে সত্ত্বগুণে উন্নীত করার প্রচেষ্ঠা করা। এভাবে ভক্তিযোগ অনুশীলনের মাধ্যমে এ ত্রিগুণ থেকে মুক্ত হওয়া যায় ।

কৌন্তেয় দাস

১. সত্ত্বগুণ সম্পন্ন খাদ্য ও জল গ্রহণ:
স্বচ্ছ জল ও নিরামিষ খাদ্য স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। মানব শরীরের প্রায় ৮০ ভাগ জল বিদ্যমান এবং জলের গুণগতমান শুধু স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে নয়, মানব মনেও প্রভাব সৃষ্টি করে। বর্তমানের লোকেরা অধিকাংশ সময়ই রাসায়নিক দূষিত জল পান করে থাকে। কিন্তু সর্বোত্তম হল বিশুদ্ধ ঝরনার জল, প্রাকৃতিক ও ঔষধি গুণসম্পন্ন ফলের রস গ্রহণ করা।
২. সত্ত্বগুণের পরবর্তী উৎস হল আবাসস্থল:
গ্রাম ও বনাঞ্চল সত্ত্বগুণের প্রভাব বহন করে। আধুনিক শহরগুলো হল রজোগুণের স্থান এবং নাইট ক্লাব, মদিরালয় ও ক্যাসিনো বা জুয়া খেলার স্থানগুলো হল তমোগুণের স্থান। হাসপাতাল, কলকারখানা, জেলখানা বা শ্মশানের নিকট বসবাস করার অনুমোদন করা হয়নি, কেননা এই সমস্ত অঞ্চলে নেতিবাচক শক্তি সঞ্চার করে। যদি কোনো ব্যক্তি পরিষ্কার প্রাকৃতিক পরিবেশে বসবাসের সুযোগ লাভ না করেন তবে অন্তত নিয়মিতভাবে ঐরকম পরিবেশে সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ ইতিবাচক।
৩. দিনের বিভিন্ন সময়:
দিনের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গুণের শক্তি বহন করে। উদাহরণস্বরূপ, প্রত্যুষে দু’ঘন্টা পূর্বে ও দু’ঘন্টা পরের সময় সত্ত্বগুণ সম্পন্ন। ঐ সময়গুলো পারমার্থিক অনুশীলনের জন্য সবচেয়ে পবিত্র সময় । সত্ত্বগুণের শক্তি তখন দিনের অন্যান্য সময়ে বিভিন্ন চাপ ও প্রতিবন্ধকতাগুলো থেকে প্রতিরক্ষা বিধান করে। সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত রজোগুণের আধিপত্য বিস্তার করে এবং লোকেদেরকে বিবিধ কার্যকলাপে নিয়োজিত করতে বাধ্য করে। সূর্যাস্তের পর তমোগুণের আধিপত্য বিস্তার করে। তখন লোকেরা আর কর্মঠ থাকে না এবং পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতেও অসমর্থ হয়ে পড়ে।
যদি কোনো ব্যক্তি না ঘুমিয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত ইন্টারনেট ও টিভি দেখে সময় কাটায় তাদের জন্য ভোরে ঘুম থেকে উঠা কষ্টসাধ্য। এরকম পরিস্থিতিতে সেই ব্যক্তির জীবনে সত্ত্বগুণের অনুপস্থিতি ঘটে এবং রাতের তমোগুণ ও দিনের রজোগুণের দ্বারা নিপীড়িত হয়। সত্ত্বগুণের কোনো পর্যাপ্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তার কাছে থাকে না।
৪. সঙ্গ প্রভাব:
সত্ত্বগুণ সম্পন্ন লোকেদের সঙ্গ প্রভাবে জীবন সম্পর্কে সঠিক উপলদ্ধি হয় এবং পারমার্থিক প্রগতির জন্য অনুপ্রেরণা লাভ করে। রজোগুণ সম্পন্ন লোকেদের সঙ্গ প্রভাবে কেউ উচ্চকাঙ্ক্ষী হয়ে পড়ে এবং জাগতিক প্রগতি সাধনে অনুপ্রেরণা লাভ করবে। তমোগুণ সম্পন্ন লোক যেমন মদ্যপায়ী, জুয়ারীদের সঙ্গের ফলে নিজের ও অন্যদের ক্ষতি সাধন হয়।
৫. আমাদের কার্যকলাপ বা কর্ম:
তমোগুণ সম্পন্ন কর্ম পরিবেশের অনিষ্ট সাধন করে এবং অন্য জীবের প্রতি সহিংস কার্যকলাপে যেমন: জীব হত্যা, কসাই ও মৎস্য পেশা প্রভৃতিতে নিয়োজিত করে। তামাক, অ্যালকোহল বা মদ ও ড্রাগস্ উৎপাদন ও বিক্রি জাতীয় এমন কর্ম যা লোকেদের অধঃপতিত করে সেগুলো হলো তমোগুণের কার্যকলাপ। রজোগুণের কর্ম হলো এমন কর্ম যা জাগতিক প্রগতি, জনপ্রিয়তা, সম্মান লাভের ক্ষেত্রে অবদান রাখে। কিন্তু তা লাভ হয় অন্যদের অধঃপতিত করার মাধ্যমে নয়, বরং নিজের প্রচেষ্টা ও সৃজনশীলতার জন্য। সত্ত্বগুণজাত কার্যকলাপ ব্যক্তির আভ্যন্তরীন শুদ্ধতা সৃষ্টি করে এবং বাহ্যিক কৃত্রিম সফলতার দিকে প্ররোচিত করে না। এ ধরনের কার্যকলাপ যেমন: নিঃস্বার্থভাবে অপরের জন্য কল্যাণমূলক কার্যকলাপ এবং সমাজে পারমার্থিক শিক্ষা বিস্তৃত করা।৬. উৎসব-অনুষ্ঠান ও প্রথাগত কার্যকলাপ:
এ সমস্ত কার্যকলাপ আমাদের শরীর ও চেতনার ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব সৃষ্টি করে। সত্ত্বগুণজাত উৎসবাদি উদ্‌যাপন পারমার্থিক প্রগতি সাধনে ভুমিকা রাখে। ভগবানের ভক্তদের মহিমামূলক ও ভগবানের আবির্ভাব দিবসসমূহ উদ্‌যাপন চিন্ময় আনন্দের সঞ্চার করে এবং চেতনার উন্নতি সাধন করে। পাবলিক অনুষ্ঠান যেমন- সামরিক কুচকাওয়াজ, ক্রীড়া প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানসমূহে কর্তৃত্ব প্রবণতার প্রদর্শন ঘটে। এমনকি শারীরিক সৌন্দর্য ও শক্তিমত্তা প্রদর্শনমূলক অনুষ্ঠাগুলো রজোগুণের লক্ষণ। মদ কিংবা নিম্ন গ্রহলোক থেকে অশরীরি আত্মাদের আহ্বান কিংবা পশু হত্যাজনিত উৎসবসমূহ হলো তমোগুণাত্মক।
৭. গ্রন্থ বা শাস্ত্র:
যে সমস্ত গ্রন্থ আমরা অধ্যয়ন করি সেগুলোও গুণের প্রভাবে প্রভাবান্বিত। সত্ত্বগুণজাত গ্রন্থ, চলচ্চিত্র বা মুভি মানুষের নিত্য চিন্ময় প্রকৃতি এবং জীবনের পরম লক্ষ্য সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেয়। এ কার্যকলাপ আভ্যন্তরীন পরিবর্তন ও আত্ম উন্নয়নের পথে উৎসাহ প্রদান করে। যে সমস্ত গ্রন্থ ও চলচ্চিত্র জাগতিক ভাবপ্রবন (Sentiments) এবং অনিত্য রোমান্টিক প্রেম ভালোবাসার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়, সেগুলো রজোগুণাত্মক এবং তা মিথ্যা অহংকার ও বাহ্যিক সফলতা প্রদান করে। তমোগুণাত্মক গ্রন্থ চলচ্চিত্রে সহিংসতা, কাম ও ভীতিপ্রদ কার্যকলাপ প্রদর্শিত হয়।
৮. গান-বাজনা, প্রার্থনা ও মন্ত্র:
মন্ত্র ও প্রার্থনা, নিঃস্বার্থভাবে ভগবানের মহিমা কীর্তন, পারমার্থিক আলোচনা এসব চেতনাকে বিকশিত করে বলে সত্ত্বগুণসম্পন্ন। জাগতিক তথাকথিত কল্যাণমূলক এবং সমৃদ্ধিমূলক যে প্রার্থনাসমূহ রয়েছে সেগুলো এই জড় জগতের প্রতি আসক্তি বৃদ্ধি করে। তাই সেগুলো রজোগুণসম্পন্ন। অভিশপ্ত কালো যাদু অনুশীলন এবং সহিংসমূলক বা অশ্লীল গান যেগুলো আমাদের চেতনাকে অত্যন্ত অধঃপতিত করে সেগুলো তামসিক।
৯. ধ্যান, প্রতিদিনের চিন্তা-ভাবনা:
নিজের শুদ্ধতার জন্য চিন্তা-ভাবনা ও পরিকল্পনা করতে হবে, যা আত্মা ও শরীরের পার্থক্য উপলদ্ধি ও ভগবানকে জানার বাসনা এবং তাঁকে সেবা করার বাসনা সত্ত্বগুণজাত। ব্যক্তিগত অভিসন্ধি পূরণের জন্য ভাবনা বা পরিকল্পনা করা, যা ইন্দ্রিয় তৃপ্তি পরিতার্থ করার জন্য সম্পদ বা সফলতা লাভের প্রতি কৰ্তৃত্বমূলক মনোভাব পোষন করা হলো রজোগুণজাত। অপরের অনিষ্টমূলক চিন্তা-ভাবনা বা পরিকল্পনা, যা ঈর্ষা, ক্রোধ ও প্রতিশোধের বাসনার প্রতিফলন সেগুলো হলো তমোগুণজাত। যার ফলে মন হতাশায় পর্যবসিত হয়ে আত্মহত্যা কিংবা সহিংস কার্যক্রমের দিকে পরিচালিত করে।
১০.জন্ম:
যে সমস্ত পিতা-মাতা বৈদিক পন্থায় সন্তান জন্ম দান করে, পারমার্থিক ও জাগতিক দুই মাধ্যমের জন্য সঠিক পন্থায় যত্ন প্রদান করে তবে সেটি হল সত্ত্বগুণজাত। সন্তান ধারনের পূর্বে সন্তান ধারনের সময় এবং সন্তান জন্মদানের পর তারা শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধসমূহ পালন করবেন, যাতে সন্তানরা পারমার্থিকভাবে বেড়ে উঠে। মদ্যপায়ী ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অধঃপতিত পিতা-মাতার পরিবারে শিশুর জন্ম তমোগুনের হয়ে থাকে। সেই সন্তান যখন বড় হয়ে উঠে তখন তার মধ্যে সদগুণাবলী প্রকাশিত হওয়ার ঘটনাটি অত্যন্ত বিরল।
যে সমস্ত পিতা-মাতা শুধুমাত্র তাদের বংশকে টিকিয়ে রাখার বাসনায় সন্তান জন্মদান করে তা রজোগুণজাত। এক্ষেত্রে বৈদিক শাস্ত্রানুসারে আমাদের মধ্যে বিরাজিত সমস্ত ত্রুটি দূর করা যাবে যদি কেউ কোনো তত্ত্বজ্ঞ গুরুদেবের কাছে থেকে দীক্ষা গ্রহণ করে সেই গুরুদেব হলেন তার পারমার্থিক পিতা এবং তিনি দীক্ষা প্রদানের মাধ্যমে তাকে পারমার্থিক জ্ঞান প্রদান করেন। এই দ্বিতীয় জন্মের প্রভাবে তার পারমার্থিক জ্ঞান ও শক্তি অর্জিত হয়। যা তার জড় আসক্তি ও দুর্বলতা দূর করে ভগবানের প্রতি অহৈতুকি প্রেমভক্তি লাভের দুর্লভ সুযোগ প্রদান করে। এটিই হলো আমাদের চিন্ময় বাস্তবতা, শাশ্বত জীবন, জ্ঞান ও সুখের পথে প্রত্যাগমনের পন্থা।


 

জানুয়ারী -মার্চ ২০১৫ ব্যাক টু গডহেড

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।