এই পোস্টটি 31 বার দেখা হয়েছে
ইস্কন প্রতিষ্ঠাতা ও আচার্য এ. সি. ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ বিশ্বে অনেক বিজ্ঞানী, কবি, দার্শনিক, সাহিত্যিকদের মাঝে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচার করেছিলেন এবং তাদের অনেকেই এই কৃষ্ণভাবনামৃত উপলব্ধি করতে পেরে তা গ্রহণ করেছিলেন। সেসমস্ত বিখ্যাত ব্যক্তিরা সারা বিশ্বে কেমন বিখ্যাত ছিলেন? এবং তারা এই কৃষ্ণভাবনামৃতের ছোঁয়ায় কেমনভাবে বদলে গেলেন? সেই সমস্ত বিশ্বের উজ্জল তারকাদের নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের ১ম পর্বটি এ সংখ্যায় তুলে ধরা হল। অ্যালেন গিনস্বার্গ পুরো নাম ইরউইন অ্যালেন গিনস্বার্গ, একজন আমেরিকান কবি। তাঁর তারকা খ্যাতি বিশ্বজনীন। কেননা ১৯ শতকের দিকে তার কবিতার লেখনীতে পুরো বিশ্বকে মুগ্ধ করেছিল। বিশেষতঃ তৎকালীন নতুন প্রজন্মদের হৃদয় আন্দোলিত করেছিলেন। খুব ছোট বেলা থেকেই বিশ্বখ্যাত নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে লেখালেখির মধ্যে দিয়ে শুরু হয় তার লেখনী জীবন। অবশেষে ধীরে ধীরে কবিতায় তার যত মনযোগ নিবন্ধ হলে একসময় হয়ে উঠে বিশ্বের অন্যতম তারকাদের একজন। সেই সূত্র ধরে গিনস্বার্গের পদ্যসমগ্র ‘দি ফল অব আমেরিকা’ জয় করে ‘জাতীয় গ্রন্থ এ্যাওয়ার্ড’ (১৯৭৪)। আরও সম্মাননার মধ্যে রয়েছে ‘জাতীয় আর্টস ক্লাব গোল্ড মেডেল’ এবং ‘আমেরিকান একাডেমী ও ইনস্টিটিউট অব আর্টস’-এর পক্ষ থেকে বিরল সম্মাননা (১৯৭৯)। ১৯৯৫ সালে গিনস্বার্গ তাঁর সর্বাধিক জনপ্রিয় গ্রন্থ ‘কসমোপলিটিয়ান গ্রিটিংস’-এর জন্য ‘পুল্টিজার’ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৩ সালে ফ্রান্সের সংস্কৃতি মন্ত্রী তাঁকে ‘চেভালিয়ার ড্রেস আর্টস এট ডেস লেট্রেস মেডেল’ প্রদান করেন। সেইরকম একজন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি কৃষ্ণভাবনামৃতের ছোঁয়ায় আসেন এ.সি ভক্তিবেদান্ত স্বামী শ্রীল প্রভুপাদের সহযোগিতায়। সেই থেকে শুরু তার বদলে যাওয়া। শ্রীল প্রভুপাদকে তিনি নানা প্রশ্নবানে জর্জরিত করতেন। শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর সেই সমস্ত প্রশ্ন সাবলিলভাবে উত্তর দিতেন। গিনস্বার্গ তার নিজস্ব দর্শন দিয়ে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে প্রভুপাদ তাঁর সেই সমস্ত ভুল ধারণার ব্যাখ্যা দিয়ে তাঁকে কৃষ্ণভক্তে রূপান্তরিত করেছিলেন। তাঁর এই পরিবর্তনে সমগ্র বিশ্ব আলোচিত হয়েছিল। কেননা তখন তিনি মিডিয়ার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই সম্পর্কে তুলে ধরেন। এমনকি ১৯৬৮ সালের দিকে উইলিয়াম এফ বাকলির সঙ্গে হারমোনিয়াম দিয়ে ‘হরে কৃষ্ণ কীর্তন’ গেয়েছিলেন এক টিভি শোতে। গিন্সবার্গের ঐ টিভি শোতে মধুর কীর্তন শুনে বাকলীর সহযোগী রিচার্ড ব্রুখিসার মন্তব্য করেন, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে মধুর গানটি (হরে কৃষ্ণ) শুনলাম। তিনি ঐ শোতে নিজে হারমোনিয়াম বাজিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি শ্রীল প্রভুপাদের প্রথম মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ দান করেছিলেন।
প্রভুপাদের প্রচার কার্যে সহযোগিতার জন্য তিনি নিজে অনেক স্থান ভ্রমণ করেছেন, অর্থ দিয়েছেন এমনকি তিনি নিজেও মানুষের মাঝে এই কৃষ্ণভাবনামৃত দর্শন বুঝিয়েছিলেন। নিম্নে অ্যালেন গিন্সবার্গের সেই স্বর্ণালী ইতিহাসগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হল।
অ্যালেন এবং পিটার কীর্তনে যোগ দিতে এসেছিল, কিন্তু তখনও কীর্তনের সময় হয়নি-প্রভুপাদ তখনও নীচে নেমে আসেননি। তারা ভক্তদের একটি নতুন হারমোনিয়াম উপহার দিয়েছিল। অ্যালেন বলেছিল, “কীর্তনের জন্য এটি আমাদের ছোট্ট একটি উপহার।” সেই দোকান-ঘরের মন্দিরে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অ্যালেন হয়গ্রীবকে বলেছিল, কিভাবে সে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় জায়গায় গিয়ে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করছে-শান্তি মিছিলে, কবিতা- আবৃত্তি অনুষ্ঠানে, প্রাগের একটি মিছিলে, মস্কোতে একটি সাহিত্য সম্মেলনে। সে বলেছিল “ঠিক তেমন পুরোদস্তুর ধর্মীয় কীর্তন না হলেও, সেটি অবশ্যই হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্রের কীর্তন ছিল।” তারপর প্রভুপাদ প্রবেশ করলেন। অ্যালেন এবং পিটার সকলের সঙ্গে মাটিতে বসল এবং কীর্তনে যোগ দিল। অ্যালেন হারমোনিয়াম বাজিয়েছিল। বক্তৃতা শেষ হলে অ্যালেন প্রভুপাদের সঙ্গে আলাপ করার জন্য এগিয়ে গেল। প্রভুপাদ তখনও প্রবচন-মঞ্চে বসে আছেন। অ্যালেন করজোড়ে নমস্কার করে প্রভুপাদের পা ছুঁয়ে প্রণাম করল, আর প্রভুপাদ মাথা নামিয়ে হাতজোড় করে প্রতি-সম্ভাষণ জানালেন। অ্যালেন হয়গ্রীবকে বলেছিল, স্বামীজীর সঙ্গে আলোচনার জন্য সে আবার আসবে, তাই হয়গ্রীব তাকে পরের দিন এসে দুপুরে প্রসাদ পাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ জানাল।
অ্যালেন গিনসবার্গ জিজ্ঞাসা করেছিল, “স্বামীজী নিউ ইয়র্কের পক্ষে কি একটু দুর্বোধ্য নয়?”
হয়গ্রীব কিছুক্ষণ চিন্তা করে তারপর উত্তর দিয়েছিল, “হয়ত তাই।” হয়গ্রীব তারপর অ্যালেনকে বলেছিল যে, স্বামীজীর ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে, তাই সে যদি তাঁকে সাহায্য করতে পারে, তা হলে খুব ভাল হয়। তিনি মোটে দু’মাসের ভিসা নিয়ে আমেরিকায় এসেছিলেন, এবং তারপর দু’মাস করে বার বার ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে তিনি প্রায় এক বছর সেখানে থেকেছেন। কিন্তু গতবার যখন তিনি ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে প্রায় এক বছর সেখানে থেকেছেন। আবার যখন তিনি ভিসার মেয়াদ বাড়াবার জন্য আবেদন করেন, তখন কর্তৃপক্ষ তা প্রত্যাখ্যান করে। হয়গ্রীব বলেছিল, “এখন আইনের মারফতে আবেদন করার জন্য একজন অভিবাসন সংক্রান্ত আইনজীবির দরকার।” অ্যালেন তাকে বলছিল, “তাতে যা খরচা হবে সেটি আমি দেব।”
পরের দিন সকালে অ্যালেন একটি চেক আর একট হারমোনিয়াম নিয়ে এসেছিল। প্রভুপাদের অ্যাপার্টমেন্টে সে তার সুরে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করে তাঁকে শুনিয়েছিল এবং তারপর প্রভুপাদের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে আলাপ- আলোচনা করেছিল।
অ্যালেন: তিনি যে কে এবং কোথা থেকে এসেছেন তা না জানায়, আমি একটু লজ্জিত বোধ করছিলাম। আমি সেই হারমোনিয়ামটি এবং কিছু টাকা দান করতে চেয়েছিলাম। তিনি যে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র প্রচার করার জন্য এসেছেন, তাতে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম-আমার মনে হয়েছিল যে, তাঁর এই প্রচার আমার কীর্তনের প্রয়াসকে চরিতার্থ করবে। আমি যে কি করছিলাম তা আমি জানতাম, কিন্তু সেই সম্বন্ধে কেউ যদি গভীরভাবে আমার কাছে অনুসন্ধান করত, তাহলে যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করে তাদের বোঝাবার মতো তত্ত্বজ্ঞান আমার ছিল না। তাই, আমেরিকায় তাঁর উপস্থিতি আমাকে খুব উৎসাহিত করেছিল। আমি মনে করেছিলাম, এখন আমি সর্বত্রই হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করে বেড়াতে পারি, আর কেউ যদি সেই সম্বন্ধে কিছু জানতে চায়, তাহলে আমি তাদের সোজা স্বামী ভক্তিবেদান্তের কাছে পাঠিয়ে দিতে পারব।
অ্যালেনের সঙ্গে প্রভুপাদের সম্পর্কটি ছিল খুব সৌহার্দ্যপূর্ণ। ভগবদ্গীতার একটি শ্লোকের উদ্ধৃতি দিয়ে শ্রীল প্রভুপাদ তাকে বুঝিয়েছিলেন যে, মহৎ লোকেরা যা করে, সাধারণ মানুষ তার অনুসরণ করে সেইভাবে আচরণ করতে থাকে। তিনি অ্যালেনকে অনুরোধ করেছিলেন সুযোগ পেলেই হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র প্রচার করতে, যাতে অন্যরা তার আদর্শ অনুসরণ করে। তিনি তাকে বলেছিলেন, ভারতবর্ষে কিভাবে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু মুসলমান নবাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ সংকীর্তন মিছিল বার করে প্রথম অসহযোগ আন্দোলন করেছিলেন। এই মহান কবি ও ভগবান কৃষ্ণের একনিষ্ঠ ভক্ত লিভার ক্যান্সারে ১৯৯৭ সালে ৫ এপ্রিল দেহত্যাগ করেন। এভাবে শ্রীল প্রভুপাদ বিশ্বের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিদেরকে এই কৃষ্ণভাবনামৃতের মাধ্যমে আকৃষ্ট করেছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেন কৃষ্ণভাবনামৃত দর্শনের কাছে সমস্ত দর্শন হার মানবেই। যেমনটি হার মেনেছিল অ্যালেন গিনস্বার্গের দর্শন। যার ফলে তাঁর জীবনের নাটকীয় পরিবর্তন হয়।
হরে কৃষ্ণ।
[তথ্যসুত্রঃ এনক্লোপিডিয়া, ইন্টারনেট, শ্রীল প্রভুপাদ লীলামৃত।।
মাসিক চৈতন্য সন্দেশ, অক্টোবর – ২০১০ ইং