এই পোস্টটি 1090 বার দেখা হয়েছে
একদিন মালতী ব্যস্তভাবে শ্রীল প্রভুপাদের অ্যাপার্টমেন্টে এসে তার থলি থেকে একটি ছোট্ট কাঠের মূর্তি শ্রীল প্রভুপাদের ডেস্কের উপর রেখে, জিজ্ঞাসা করল, “এটা কি, স্বামীজী?” শ্রীল প্রভুপাদ নীচু হয়ে বড় বড় চোখ, চ্যাপ্টা মাথা, হাস্যোজ্জ্বল তিন ইঞ্চি লম্বা কালো পুতুলটিকে দেখতে লাগলেন। পুতুলটির গঠন মোটাসোটা, তার হাত দুটি সামনের দিকে বেরিয়ে আছে, তার বক্ষঃস্থল হলুদ আর সবুজ রঙে সাধারণভাবে রঙ করা আর তাতে কোন পা দেখা যাচ্ছে না। শ্রীল প্রভুপাদ তৎক্ষণাৎ সেই ছোট্ট মূর্তিটিকে শ্রদ্ধা সহকারে মাথা নীচু করে করজোড়ে প্রণতি নিবেদন করলেন। আনন্দে তাঁর চোখ দুটি ঊজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং তিনি হেসে বললেন, “তুমি জগতের নাথ জগন্নাথকে নিয়ে এসেছ। ইনি হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ। তোমায় অসংখ্য ধন্যবাদ।” শ্রীল প্রভুপাদ আনন্দোজ্জ্বল হয়ে উঠলেন, আর স্বামীজেকে এইভাবে আনন্দ দিতে পেরে মালতী এবং অন্যরা বিস্ময়াবিষ্টচিত্তে মেঝের উপর বসে রইল। শ্রীল প্রভুপাদ তাদের বোঝালেন যে, এটি হচ্ছে শ্রীজগন্নাথদেবের শ্রীবিগ্রহ, শ্রীকৃষ্ণের একটি বিগ্রহ, যা হাজার হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষে পূজিত হচ্ছে। তিনি বলেছিলেন যে, আরও দুটি শ্রীবিগ্রহ-তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলরাম এবং ভগিনী সুভদ্রাসহ তিনি পূজিত হন। উত্তেজিতভাবে মালতী জানাল যে, কোস্ট প্লাস নামক বিদেশ থেকে রপ্তানি করা জিনিসের দোকানটিতে সে এই ছোট্ট জগন্নাথকে খুঁজে পেয়েছিল। সেখানে এই রকম আরও কয়েকটি মূর্তি সে দেখেছে এবং শ্রীল প্রভুপাদ তাকে বলেছিলেন, তৎক্ষণাৎ সেখানে গিয়ে সেগুলি কিনে আনতে। মালতী তার স্বামী শ্যামসুন্দরকে সেই কথা জানিয়েছিল এবং তারা দু’জনে তৎক্ষণাৎ সেই মূর্তি দুটি কিনে আনবার জন্য সেখানে ছুটে গিয়েছিল। শ্রীল প্রভুপাদ কৃষ্ণবর্ণ, হাস্যোজ্জ্বল জগন্নাথকে ডানদিকে রেখেছিলেন। লাল হাস্যোজ্জ্বল মুখ, চৌকো চোখ এবং হলুদ রঙের অবয়ব-বিশিষ্ট সব চাইতে ছোট্ট মূর্তি সুভদ্রাকে মাঝখানে রেখেছিলেন এবং সাদা গোল মাথা, লাল রংঙের চক্ষু বিশিষ্ট, হাস্যোজ্জ্বল, জগন্নাথের মতো হাত দুটি সামনের দিকে বের করা এবং লীল আর হলুদ অবয়ব-বিশিষ্ট বলরামকে বাঁদিকে সুভদ্রার পাশে রেখেছিলেন। তাঁর ডেস্কের উপর তাঁদের দিকে তাকিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কেউ কাঠখোদাই-এর কাজ জানে কি না। শ্যামসুন্দর জানিয়েছিল যে, সে একজন ভাস্কর এবং শ্রীল প্রভুপাদ তাকে বলেছিলেন, এই জগন্নাথ, বলদেব ও সুভদ্রার তিন ফুট উঁচু প্রতিকৃতি খোদাই করতে।
শ্রীল প্রভুপাদ তাদের বলেছিলেন যে, দু’হাজার বছর আগে ইন্দ্রদ্যুম্ন নামক এক কৃষ্ণভক্ত রাজা ছিলেন। সূর্যগ্রহণের সময় শ্রীকৃষ্ণ যখন তাঁর ভ্রাতা ও ভগিনীসহ কুরুক্ষেত্রে গিয়েছিলেন, সেই প্রকাশের বিগ্রহ মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন খুঁজছিলেন। রাজা যখন স্বর্গের কারিগর বিশ্বকর্মাকে সেই রূপের মূর্তি তৈরি করতে অনুরোধ করেন, তখন একটি শর্তে বিশ্বকর্মা রাজী হয়েছিলেন-তাঁর কাজের সময় কেউ তাঁকে বাধা দিতে পারবে না। দরজা বন্ধ করে বিশ্বকর্মা যখন কাজ করছিলেন, তখন দীর্ঘকাল রাজা অপেক্ষা করে ছিলেন। কিন্তু একদিন রাজা আর অপেক্ষা করতে পারলেন না। তিনি দরজা খুলে কতটা কাজ হয়েছে, তা দেখতে গেলেন। তাঁর শর্তানুসারে তিনটি অসম্পূর্ণ মূর্তি রেখে, বিশ্বকর্মা সেখানে থেকে চলে গেলেন। শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম এবং সুভদ্রার এই বিস্ময়কর মূর্তিগুলি পেয়ে, রাজা আনন্দে অধীর হয়ে তাঁদের পূজা করতে মনস্থ করলেন। তিনি তাঁদের একটি মন্দিরে প্রতিষ্ঠি করলেন এবং আড়ম্বরে তাঁদের পূজা করতে শুরু করলেন।
শ্রীল প্রভুপাদ বলতে লাগলেন যে, সেই সময় জগন্নাথদেবে সমগ্র ভারতবর্ষে পূজিত হচ্ছেন, বিশেষ করে উড়িষ্যার জগন্নাথপুরীতে, যেখানে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার সময় মহা সমারোহে শোভাযাত্রা সহকারে তিনটি বৃহৎ রথে চড়ে জগন্নাথ, বলদেব এবং সুভদ্রা যখন যান, তখন লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী তাঁদের প্রতি পূজা নিবেদনের উদ্দেশ্যে সেখানে সমবেত হন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যখন তাঁর জীবনের শেষ আঠারো বছর জগন্নাথপুরীতে অতিবাহিত করেন, তখন তিনি প্রতি বছর এই রথযাত্রা মহোৎসবে আনন্দে মগ্ন হয়ে, জগন্নাথদেবের শ্রীবিগ্রহের সামনে র্কীতন এবং নৃত্য করতেন।
শ্রীল প্রভু বলেছিলেন, জগন্নাথদেব যেহেতু তাঁর অহৈতুকী কৃপার প্রভাবে সান ফ্রান্সিসকোতে আবির্ভূত হয়েছেন, তখন তাদের কর্তব্য হচ্ছে গভীর নিষ্ঠা এবং ঐকান্তিকতা সহকারে জগন্নাথদেবকে গ্রহণ করা এবং তাঁর আরাধনা করা। শ্রীল প্রভুপাদ বলেছিলেন যে, শ্যামসুন্দর যদি জগন্নাথদেবের শ্রীবিগ্রহ প্রকট করতে পারে, তা হলে তিনি সেই বিগ্রহগুলি মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করবেন এবং ভক্তরা বিগ্রহগুলির পূজা শুরু করতে পারবে। তিনি সান ফ্রান্সিসকোর নতুন নামকরণ করেছিলেন ‘নব জগন্নাথপুরী’। তিনি গেয়েছিলেন, “এটি হচ্ছে জগন্নাথদেবের মন্ত্র-‘হে জগতের পতি শ্রীজগন্নাথদেব! দয়া করে আপনি আমার নয়নপথে গমন করুন, যাতে আমি আপনাকে দর্শন করতে পারি।’ তিনি যে এখানে প্রকট হতে মনস্থ করেছেন তা অত্যন্ত মঙ্গলজনক।”
শ্যামসুন্দর তিনটি বড় বড় কাঠের গুঁড়ি নিয়ে এসেছিল এবং শ্রীল প্রভুপাদ একটি নক্শা করে দিয়েছিলেন এবং সেই সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছিলেন, ছোট মূর্তিগুলির মাপ অনুসারে শ্যামসুন্দর তার বাড়ির বারান্দায় সেই কাঠগুলি খোদাই করতে শুরু করেছিল। ইতিমধ্যে ভক্তরা কোস্ট প্লাস নামক দোকানটি থেকে জগন্নাথদেবের বাকি সমস্ত মূর্তিগুলি কিনে নিয়েছিল এবং ক্ষুদ্র জগন্নাথকে একটি গলার হারে ঝুলিয়ে পরাটা প্রচলিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শ্রীল প্রভুপাদ বলেছিলেন, জগন্নাথদেব যেহেতু অত্যন্ত উদার এবং অধঃপতিত জীবদের প্রতি অত্যন্ত কৃপাময়, তাই ভক্তরা অচিরেই তাঁকে তাদের মন্দিরে পূজা করতে সমর্থ হবে। মন্দিরে শ্রীশ্রীরাধা-কৃষ্ণের পূজা করতে হলে কঠোর নিয়মকানুন এবং অতি উচ্চমানের সেবা প্রয়োজন, যা ভক্তরা এখনও অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু জগন্নাথথদেব এতই কৃপাময় যে, তাঁকে খুব সরল পদ্ধতিতে আরাধনা করা যায় (বিশেষভাবে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করার মাধ্যমে), এমনকি ভক্তরা যদি অতি উন্নত পর্যায়ভুক্ত না-ও হয়। ক্রমশ, তারা যতই পারমার্থিক জীবনে উন্নতি লাভ করছিল, স্বামীজী ততই আরও বেশি করে গভীর ভগবৎ-তত্ত্ব উপলব্ধি সহ বিগ্রহ পূজার বিশদ নিয়ম-পদ্ধতি তাদের নিকট উপস্থাপনা করতেন। সেদিন সন্ধ্যায় ভক্ত এবং হিপি অতিথিতে সেই ঘরটি পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। শ্রীল প্রভুপাদ তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং সেখানকার পরিবেশটি শ্রদ্ধামিশ্রিতভাবে আনন্দোচ্ছল হয়ে উঠেছিল। সেটি ছিল একটি বিশেষ অনুষ্ঠান। সদ্যনির্মিত শ্রীবিগ্রহগুলি পূজামঞ্চে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং রেড়উডের তৈরী বেদিমঞ্চে হলদে চাঁদোয়ার নীচে উজ্জ্বল আলোতে উদ্ভাসি সেই শ্রীবিগহের দিকে সকলেই তাকিয়েছিল। শ্রীবিগ্রহগুলির পরনে কোন কাপড় বা অলঙ্কার ছিল না, কিন্তু তাঁদের উজ্জ্বল কালো, লাল, সাদা, সবুজ, হলুদ এবং নীল রঙ দিয়ে রাঙানো হয়েছিল। তাঁদের মুখমণ্ডল ছিল হাসোজ্জ্বল। তাঁদের সেই উচ্চ পূজামঞ্চে শ্রীল প্রভুপাদও তাঁদের দেখছিলেন।
প্রভুপাদ তারপর শ্রীবিগ্রহ প্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠান শুরু করতে চান। পারমার্থিক জীবনের জন্য যা প্রয়োজন, তা সবই এখানে রয়েছে-মন্দির, ভক্ত, গ্রন্থ, শ্রীবিগ্রহ, প্রসাদ। তিনি চেয়েছিলেন, এই সমস্ত অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েরা এর সদ্ব্যবহার করুক। তারা কেন পশুর মতো জীবন যাপন করতে থাকবে এবং পারমার্থিক জীবন সম্বন্ধে ‘কোন একটি কিছু’ বলে মনে করে একটি ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করবে? তারা শ্রীকৃষ্ণের করুণা গ্রহণ করুক এবং তাদের জীবনকে যর্থাথভাবে সাফল্যমণ্ডিত করে সুখী হোক। আর সেজন্য শ্রীল প্রভুপাদ ছিলেন তাদের শ্রান্তিহীন সেবক। হরেকৃষ্ণ।
(মাসিক চৈতন্য সন্দেশ জুন ২০০৯ সালে প্রকাশিত)