ছোট সরস্বতী ও ইস্‌কনের সূচনা লগ্ন

প্রকাশ: ২৪ অক্টোবর ২০২১ | ৬:৪১ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০২১ | ৬:৪১ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 216 বার দেখা হয়েছে

ছোট সরস্বতী ও ইস্‌কনের সূচনা লগ্ন
শ্রীল প্রভুপাদ বললেন, আজ সকালে এই মেয়েটিকে (শিশু সরস্বতীকে) স্বপ্নে দেখেছি, ঠিক এই মেয়েটিকেই। কৃষ্ণভাবানামৃত আন্দোলনে জন্ম নেওয়া প্রথম শিশু।

সত্যরাজ দাস

ইস্‌কনের সূচনাকালীন ইতিহাসের যে কোন পূর্ণ বিবরণে একটি নাম অবশ্যই উল্লেখ্য করবে, তা হল ছোট্ট সরস্বতী এই আন্দোলনটির সূচনাকালীন সদস্য শ্যামসুন্দর প্রভু এবং মালতি মাতাজী কন্যা। শ্রীল প্রভুপাদের আন্দোলনটি জগৎ জুড়ে বিস্তৃত করার কাজে সাহায্য করার জন্য দুই জনই আজ সুপরিচিত। শ্রীল প্রভুপাদ ছোট্ট সরস্বতীর জন্য প্রায়ই গর্ববোধ করতেন এবং প্রায়ই তাঁর আন্দোলনে মাতাজী সরস্বতীর গুরুত্বের কথা উল্লেখ করতেন যখন তিনি দেখাতেন কিভাবে যে কেউ আক্ষরিক অর্থেই এই আন্দোলনে অংশ নিতে পারে। শ্রীল প্রভুপাদ ছোট্ট মেয়ে সরস্বতীর উদাহরণ দিয়ে বলতেন এমনকি একটি ছোট মেয়েও এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে ও হরে কৃষ্ণ জপ করতে পারে। এটি সহজ এবং মহৎ। এমনকি ধারণা করা হয় যে, সরস্বতী মাতাজী হচ্ছেন শ্রীল প্রভুপাদের কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনের কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রহণকারী প্রথম শিশু। তাঁর এই শুভ জন্ম “কৃষ্ণের ধারণার” একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কৃষ্ণভাবনামৃতের মূল ভাবটি হচ্ছে, যে কেউই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত হতে পারে। জাতি-বর্ণ-নির্বিশেষে যাঁকে যেকোন নামে পৃথিবীর যেকোন ভাষায় ডাকা যায়। নারী-পুরুষ-জাতি ও বয়স কোন কিছুর সাথেই এর কোন সম্পর্ক নেই। এটি শুধুই একজনের হৃদয়কে উন্মোচন করা এবং অন্তরে তা গ্রহণ করা; যেমনটি মাতাজী সরস্বতী করছেন। পিছনের গল্পটি সবার জানা। ভগবান কৃষ্ণের অমৃত বাণী পশ্চিমে ছাড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ১৯৬৫-এ ৬৯ বছর বয়সে অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী শ্রীল প্রভুপাদ ভারতের পুণ্যভূমি বৃন্দাবন ত্যাগ করে পশ্চিমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। একমাসের কিছু সময় পরে তিনি শুধু চল্লিশ রুপি এবং বই ভর্তি একটি ট্রাঙ্ক নিয়ে একটি কার্গো শিপে করে বোস্টনে পৌঁছান। ট্রাঙ্কের ভিতরে অমূল্য সম্পদ এই বইগুলো ছিল তাঁর নিজের অনুবাদকৃত শ্রীমদ্ভাগবতের ১ম খণ্ড, আক্ষরিক অর্থে জগতকে দেওয়া তাঁর প্রথম কৃপা। কয়েক বছরের মধ্যে এই কৃপাই পরিণত হবে বৈদিক জ্ঞান-সাগরের গুরুত্বপূর্ণ পুস্তকে। শীঘ্রই শ্রীল প্রভুপাদ নিউইয়র্কে গেলেন, যেখানে ১৯৬৬ সালে তিনি একটি মন্দির খুললেন এবং ইস্‌কনের কার্যক্রম শুরু করলেন। আগ্রহী ভক্তরা তাঁর সাথে যোগদান
করলেন এবং তাঁর শিক্ষাকে তাঁরা তাদের জীবন সর্বস্ব করলেন। হরে কৃষ্ণ যত শীঘ্রই বলা যায় ঠিক তত শীঘ্রই প্রথম মন্দির স্থাপিত হলো অল্পবয়স্ক ভগবৎ অনুসন্ধানকারী এবং সদ্য দীক্ষিত নতুন ভক্তদের নিয়ে এবং ভক্তদের প্রয়োজন মেটাতে আরও নতুন মন্দিরের প্রয়োজন দেখা দিল। শ্রীল প্রভুপাদের প্রথমদিকের একনিষ্ঠ ভক্তদের মধ্যে মাইকেল গ্র্যান্ট একজন। তিনি ছিলেন একজন জ্যাজ মিউজিশিয়ান; যিনি মুকুন্দ দাস হন এবং পরবর্তীতে মুকুন্দ গোস্বামী নামে পরিচিত হন। একই সাথে ইনি ছিলেন শ্রীল প্রভুপাদের স্পষ্ট ভাষী সমর্থকদের একজন। দীক্ষার পরে মুকুন্দ প্রভু ভারত ভ্রমণের
পরিকল্পনা করেন, কিন্তু পুরোনো বন্ধুদের পশ্চিম উপকূল ভ্রমণ পরিকল্পনার জন্য তা বাদ দেন। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী (জানকী দাসী মাতাজী) ও তার বোন জুয়ানকে দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন; যিনি পরবর্তীতে তাঁদের সাথে যোগদান করেন এবং পরে যমুনা দেবী হন। মুকুন্দ প্রভু এবং জানকী মাতাজী তাঁদের কাছের বন্ধুদের নিকট নিউইয়র্কে শ্রীল প্রভুপাদের দেখা হওয়ার কথা বলতে চাইলেন। সুতরাং ১৯৬৬ এর অক্টোবরের শুরুতে তাঁরা আমেরিকা পাড়ি দিলেন। বোন ওরেগন এর উদ্দেশ্যে যেখানে তাঁরা স্যাম স্পিয়ারস্ট্রা এর সাথে পুনরায় মিলিত হবেন যিনি সম্প্রতি একটি ডিগ্রী নিয়েছিলেন। তিনি আমেরিকার বন অধিদপ্তর এর সাথে ডকুতেস ন্যাশনাল ফরেস্ট এ জালানি খোঁজার কাজ করতেন। তিনি একটি পাহাড়ের উপর ত্রিশ মিটার উঁচু একটি টাওয়ারে তার বান্ধবী মেলানিয়া লি নাগেল এর সাথে থাকতেন। মুকুন্দ প্রভু তাদের শ্রীল প্রভুপাদের সততার ব্যাপারে আশ্বস্ত করলেন। তারা শীঘ্রই ভক্তে পরিণত হলেন। স্যাম হলেন শ্যামসুন্দর এবং মেলানিয়া হলেন মালতী মাতাজী। এইসব ভক্তরা গুরুদাস প্রভু (যমুনা দেবীর স্বামী)-র সাথে কাজ করেন সান ফ্রান্সিসকোতে একটি হরে কৃষ্ণ মন্দির খোলার জন্য এবং তাঁরা চাইছিলেন শ্রীল প্রভুপাদকে আমন্ত্রণ দেবেন এই মন্দিরের মহতী উদ্বোধনের জন্য। এইভাবে পশ্চিম উপকূলের চেহারা বদলে দিবেন এবং এখান থেকে পুরো পৃথিবীর। এটা ছিল হিপি যুগের শীর্ষ সময় যখন ভালবাসাই ছিল এর মূল কেন্দ্র। ভক্তরা এই ভালবাসাকে অধিকতর গভীরতার সাথে কৃষ্ণভাবনামৃতের সাথে জড়িত করতে চাইলেন। তাঁরা জানতেন শ্রীল প্রভুপাদের উপস্থিতি এই কাজটি করতে পারে। ফলস্বরূপ, তাঁরা প্রথম হরে কৃষ্ণ মন্দির খুললেন সানফ্রান্সিসকোর হাইট-অশ্বরী ডিস্ট্রিক্ট এ, এটি ছিল হরেকৃষ্ণ আন্দোলনের দ্বিতীয় মন্দির। অনেকেই পরবর্তীতে তাঁদের অনুসরণ করলেন। এটা ছিল গ্রীষ্মের ভালবাসাপূর্ণ দিনগুলির পরবর্তী সময় (১৯৬৭) যখন সান ফ্রান্সিসকোতে সরস্বতী তাঁর মায়ের গর্ভে আসেন। পরবর্তী গ্রীষ্মে, জুন এর ১৭ তারিখ বর্তমানে যেটি রথযাত্রা মহোৎসব নামে পরিচিত তার ঠিক দুই সপ্তাহ আগে তিনি জন্মগ্রহণ করলেন। ভগবান জগন্নাথ দেবের কৃপাধন্য এই শিশুটি সে উৎসবে ছিল।

কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনের প্রসার

মন্ট্রিলে তৃতীয় মন্দির খোলা হল এবং ১৯৬৮ সালের গ্রীষ্মে প্রভুপাদ সেখানেই ছিলেন। সরস্বতী মাতাজী যেদিন জন্মগ্রহণ করেন প্রভুপাদ সেই দিনই তার নাম রাখেন সরস্বতী। শ্যামসুন্দর প্রভু লিখেছেন, “সাধারণের জন্য হল রুমে রাখা টেলিফোনটির দিকে ছুটে গেলাম এবং মন্ট্রিয়েল মন্দিরে ফোন করলাম। মন্দিরের প্রভুর কাছ থেকে উত্তর এল “ভক্তিবেদান্ত স্বামী এখন এখানে আছেন।”
তারপর কি ঘটল শ্যামসুন্দর প্রভু তা আমাদের বললেন, স্বামীজী সান ফ্রান্সিসকোতে আজ আমাদের সন্তানের জন্ম হয়েছে। এটি একটি কন্যাশিশু। আপনি কি তার জন্য একটি নাম দিবেন? সামান্য বিরতি। তারপর উত্তর এল “তাকে ডাকা হবে সরস্বতী দেবী দাসী নামে।” অত্যন্ত খুশি হয়ে আমি মালতীর কাছে ছুটে গিয়ে চিৎকার করে বললাম “এ হচ্ছে সরস্বতী”। সরস্বতী সংগীত ও বিদ্যার দেবী এবং সরস্বতী মাতাজী হলেন কৃষ্ণভাবানামৃত আন্দোলনে জন্ম নেওয়া প্রথম শিশু। শ্রীল প্রভুপাদ শচীসূত প্রভুকে জুন ১৭, ১৯৬৮ সালের লেখা একটি চিঠিতে লিখেন “আমি এই মাত্র সানফ্রান্সিসকো থেকে ফোনে সংবাদ পেলাম মালতী এবং শ্যামসুন্দরের একটি কন্যা সন্তান হয়েছে। তারা আমাকে তার জন্য একটি নাম দিতে বলল এবং আমি তার নাম রাখলাম সরস্বতী দেবী। কৃষ্ণভাবনামৃতের এই নবজাতক শিশুটির জন্য প্রার্থনা কর।”
এরপর শীঘ্রই শ্যামসুন্দর ঠিক করলেন তিনি বিটল্সের সাথে দেখা করবেন তাদের সাথে কৃষ্ণভাবনামৃত ভাগাভাগি করার জন্য। কেন তিনি এই অনুপ্রেরণা পেলেন অথবা এই পরিকল্পনাটি ফলদায়ক হবে কি না তা না জেনেই তিনি ঠিক করলেন তিনি পুনর্মিলনী আয়োজন করবেন এবং ইংল্যান্ডে সফরের ও পরিকল্পনা করলেন। তিনি যুক্তি দেখালেন, যাই হোক জর্জ হ্যারিসন প্রাচ্য সংগীত ও আধ্যাত্মিকতার দিকে গভীরভাবে ঝুঁকছেন, হয়তো আমি কৃষ্ণভাবনামৃতকে সমর্থন করি। তাছাড়া শ্রীল প্রভুপাদ লন্ডনের কথা বলতেন বিশেষ করে ব্রিটিশ রাজত্বে ভারতের উপর প্রভাবের কথা। তাই শ্যামসুন্দরের এই সাক্ষাৎকারটি হয়ে উঠল তার ধ্যান জ্ঞান এবং এটি পরিষ্কার হয়ে উঠল যে শ্রীল প্রভুপাদ চাইতেন পৃথিবীর এই অংশে ইস্‌কন তার বিস্তৃতি ঘটাক। কিন্তু শ্রীল প্রভুপাদ শ্যামসুন্দরকে বললেন যে, ভ্রমণের পূর্বে বাচ্চাটির বয়স অবশ্যই অন্তত ছয় সপ্তাহ হতে হবে। সুতরাং আমরা দ্রুত মুকুন্দ, জানকী, গুরুদাস, যমুনার সাথে দেখা করলাম। সান ফান্সিসকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য একটি তারিখ ঠিক করতে শ্যামসুন্দর প্রভু লিখছেন, “আমরা ঠিক করলাম প্রথমে মন্ট্রিয়েল যাব শ্রীল প্রভুপাদের আশীর্বাদের জন্য এবং লন্ডনে কী করতে হবে তার দিকনির্দেশনার জন্য। আমরা আগস্টের শেষের দিকে যাত্রার সময় ঠিক করলাম।”
এই তিন দম্পতি ও ছোট্ট সরস্বতী ১৯৬৮ সালের ১০ আগস্ট কানাডায় পৌঁছাল এবং মন্ট্রিলের নতুন মন্দিরের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করল। গোবিন্দ দাসী মাতাজী শ্রীল প্রভুপাদের সহকারী, তাদের দরজায় অভিবাদন জানালেন এবং তাদের দেখেই প্রভুপাদ বললেন, “আজ সকালে এই কন্যাটিকেই আমি স্বপ্নে দেখেছি, ঠিক এই কন্যাটিকেই। তিনি সরস্বতীর দিকে এক মুহূর্তের জন্য তাকালেন এবং বললেন, “তোমার কি আমাকে মনে আছে? আমি তোমার পুরনো বন্ধু । “সরস্বতী তার বড় বড় চোখে আগ্রহের সাথে তাঁর দিকে তাকালো। শ্রীল প্রভুপাদ তার দিকে তাকিয়ে স্নেহে হাসলেন। সে তার “পুরনো বন্ধুর” সাথে মুখোমুখি হল। দুই দিন পর শ্রীল প্রভুপাদ হয়গ্রীবকে (নিউইয়র্কে তাঁর প্রথম শিষ্যদের একজন) লিখলেন, “শনিবার সানফ্রান্সিসকো থেকে অনেক ভক্ত এসেছে- মুকুন্দ-জানকী, গুরুদাস-যমুনা, শ্যামসুন্দর-মালতী এবং তাদের ছোট্ট মেয়ে শ্রীমতী সরস্বতী দেবী। একসাথে সংকীর্তন অভ্যাস করার জন্য তারা সকলে এখানে এসেছে দুই সপ্তাহের জন্য তারপর তারা লন্ডন যাবে এবং সেখানে আমাদের সেন্টারের জন্য প্রস্তুতি শুরু করবে। তুমি যখন এখানে থাকবে তখন আমরা প্রতিদিন কীর্তনের অনুশীলন করতে পারব।
শ্রীল প্রভুপাদ প্রায়ই ছোট্ট সরস্বতীর প্রতি তাঁর চিন্তার কথা প্রকাশ করতেন। এই মহৎ এবং বাড়তে থাকা আন্দোলনের মাঝে সে ছিল এত ছোট এবং তার চার পাশে ছিল এত সব কর্মযজ্ঞ। যাই হোক, ছোট্ট সরস্বতী ছিল একজন হাসিখুশি অতিথি এবং এর পুরোটাই ছিল মালতীর কৃতিত্ব। শ্রীল প্রভুপাদ চিন্তা করলেন, “আমি দেখছি বাচ্চা সরস্বতী সবসময়ই খায়। “মালতী ছোট্ট সরস্বতীকে ভালভাবে খাইয়ে আসতো যাতে সে আমার আলোচনার প্রতিদিন অংশগ্রহণ করতে পারে এবং বাচ্চাটি খেলত, কখনোই কাঁদত না। লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার পরপরই শ্রীল প্রভুপাদ তাদের তাঁর গভীর ভালবাসা, স্নেহাশীষ পাঠলেন; বিশেষ করে ছোট্ট সরস্বতীর প্রতি, যাকে তিনি জানিয়েছিলেন বিশেষ বিদায় অভ্যর্থনা।
শ্যামসুন্দর লিখছেন, “শ্রীল প্রভুপাদ বললেন, সরস্বতীকে তাঁর কাছে সমর্পণ করতে। তিনি তাঁকে আলাদাভাবে আঁকড়ে ধরলেন এবং বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন এবং দু’জনের গলাতেই তাঁর গলার মালাটি জড়ালেন এবং ভালবাসার সাথে তাঁর নিজস্ব রসাত্মক ভঙ্গিতে বললেন, “এখন এরা বলবে, ইনি কেমন সন্ন্যাসী?”

মালতী : আমার মনে হয় না যে, এখানে এরকম কোন ছবি আছে। এটি ছিল একটি আন্তরিকতাপূর্ণ খেলা। এমনকি আমরা এটাও ভাবছিলাম যে, আমরা কি আপনাকে আর দেখব? আমাদের ছিল ওয়ান-ওয়ে টিকেট আমরা স্থির করলাম ছোট ডেস্কের পেছনে শ্রীল প্রভুপাদের সেই সুন্দর দৃশ্যটি আমরা উপভোগ করব। এটি জেনে যে, আমরা কখনোই তাকে আর দেখব না, হয়তো আর কখনোই না এবং সত্যিই এক বছরের জন্য আমরা সেইবারই তাঁকে শেষ বারের মতো দেখেছিলাম। সরস্বতীর বয়স এখন নয় সপ্তাহ। সে সহ এই তিন দম্পতির লুক্সেমবার্গ পর্যন্ত ওয়ান-ওয়ে টিকেট ছিল। তাদের প্রায় তেমন কোন টাকা ছিল না এবং সেখানে পৌঁছালে অভিবাদন করবে এমন লোকও ছিল নাÑতাদের যা ছিল তা হল প্রভুপাদের এই মিশনের উপর বিশ্বাস।

বিটল্‌সের সাথে সাক্ষাৎকার ও হৃদয় জয়

তারা নিউইয়র্কে একটি স্বল্পকালীন বিরতির পরিকল্পনা করলেন যখন তারা পূর্ব উপকূলে প্রভুপাদের অন্যান্য শিষ্য নতুন ভাই বোনদের এবং ইস্‌কনের প্রধান মন্দিরটি দেখলেন। সেখান থেকে তারা লন্ডনে গেলেন। সেখানে পৌঁছলেন আগস্টের ২৮ তারিখ। ইউকে তে যাতে কৃষ্ণভাবনামৃত পরিচিতি লাভ করে তার জন্য তারা সেখানে কয়েক মাস কঠোর সংগ্রাম করলেন; যেখানে থাকার জায়গা জুটত, সেখানেই থাকতেন। যদিও এটি তাদের যা ছিল সব নিয়ে নিল তবুও ছয় ভক্ত আর ছোট্ট সরস্বতী ছিল খুশি এবং তারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র করে সাফল্য লাভ করতে লাগল। যাই হোক, শ্যামসুন্দরের স্বপ্ন সত্যি হল -অন্তত এর প্রথম অংশটা।
আমি লন্ডনে কৃষ্ণভাবনামৃতের প্রচার করছিলাম। এখন সব থেকে কঠিন অংশ বিটল্‌সের সাথে মিলিত হওয়া। কেমন করে তিনি “ফেবুলাস ফোর” যেমনটা তাদের ডাকা হতো, এর সাথে সাক্ষাৎকার করলেন তার বিস্তৃত বর্ণনা অনেকেই করেছেন। শ্যামসুন্দর এই সাক্ষাৎকারের গল্পটি Hunting Rhinos with the Swami , Joshua Green [যোগেশ্রবা দাস] এর জজ্ হ্যারিসনের বায়োগ্রাফি (Here Comes the Sun: George Harrison’s spiritual and musical journey ) and Prabhupada (Swami in a strange land : how Krishna came to the West) এসব বইগুলিতে ভালভাবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু আমাদের এই বর্তমান প্রবন্ধের প্রেক্ষিতে মেয়েটা গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হল এই বিখ্যাত পপ ব্যান্ডের সাথে সরস্বতীর মুখোমুখি হওয়া।
আমি উচুঁ সিঁড়িতে উঠলাম এবং পরিচিতি পর্বটি সারলাম। সকলেই ছিল কিছুটা কুন্ঠিত, হাসি খুশি এবং রোমাঞ্চিত। আমি মেয়েদের আগে পরিচয় করিয়ে দিলাম। জর্জ, এই হচ্ছে আমার স্ত্রী মালতী (তিনি আগেই জর্জকে বলেছিল যে, মেলানিয়া আগে ছিল ফ্রিসকো শহরের আধুনিক এক সুকেশী সুন্দরী রমণী কিন্তু এখন কিছুটা দুর্বল ও কিছুটা আরক্তিম হল যখন সে তাড়াতাড়ি মালাটা তার গলায় পড়ে নিল)। এ হচ্ছে যমুনা (বাল্যকাল থেকে আমার বিচক্ষণ বন্ধু জন, যার গলার স্বর ছিল দেবদূতের মতো। ইনি হচ্ছেন ভগিনী জানকী এবং জানকীর স্বামী মুকুন্দ (আমার পুরনো কলেজ বন্ধু, যে আমাদের মধ্যে প্রথম ভক্তিবেদান্ত স্বামীকে দর্শন করেন; যার আসল নাম ম্যাইকেল গ্রান্ট একজন অসাধারণ জ্যাজ পিয়ানো বাদক) এবং গুরুদাস, যমুনার স্বামী (নিউইয়র্কের একজন স্বপ্নদর্শী এবং সানফ্রান্সিসকোর সুদর্শন পুরুষ”
গুরুদাস শেকটি ভাঙল “অবশ্যই খেতে যাবেন” আমরা সকলেই মেঝেতে জড়ো হলাম। মেয়েরা খাবারের প্লেট থালা বাটি দিতে শুরু করল এবং থালাগুলো ভারতীয় খাবারে ভরিয়ে তুলল। ঠিক এই সময় সরস্বতী হামাগুঁড়ি দিয়ে এল, জর্জের প্লেট থেকে একটি চাপাটি নিল এবং সেটি তার মুখে সেঁটে দিল। জর্জ অপ্রস্তুত হয়ে বলল ও ধন্যবাদ সরস্বতী কিন্তু সে একটু খেল। মালতী তাকে টেনে আনল এবং তাকে তার কোলে নিয়ে নিল সকলেই হাসতে লাগল।
সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখ শনিবারে আমরা জর্জ ও প্যাটি হ্যারিসন এর সাথে জন ও ইয়োকোকে আমাদের নতুন মন্দিরের গ্যালেরিতে পিকনিকের আমন্ত্রণ জানালাম। মেয়েরা দুপুরের জন্য অনেকবার কম খাবার তৈরি করলেন। আমরা কীর্তন করলাম এবং ঠান্ডা টাইলসের ফ্লোরে সকলে বসলাম। আমরা খেতে লাগলাম এবং একে অপরের সাথে আলাপ করলাম। জানকী জনকে শিখিয়েছিল কিভাবে করতাল বাজাতে হয়। সরস্বতী যে এখন হাঁটতে পারে সকলকে মুগ্ধ করে রেখেছিল। গুরুদাস দৌঁড়ে গেল এবং কিছু সাদা কালো ছবি তুলল যা জন ও ইয়োকোকে সামান্য চিন্তিত করে তুলল। সকলেই প্রসাদম্ পছন্দ করল এবং সকলেই স্বীকার করল যে এটি ছিল একটা সেরা দিন। কিন্তু যদি সরস্বতী বিটল্সের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পারে যেমনটা সে করেছিল ও তাহলে সে শ্রীল প্রভুপাদের সাথে ও একইরকম কাজ করেছিল। তার শিশুসুলভ ভঙ্গিতে এটি পারত। সে জানত প্রভুপাদের কাছে আছে কৃষ্ণের কাছে যাওয়ার চাবিকাঠি। নিম্নোক্ত ঘটনাটির মাধ্যমে এর সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে :
“এই দেখ, এখানে মিস্ সরস্বতী”
“পা-পা-পাদ”
সরস্বতী মুখ তুলে তাকাল তার ছোট্ট বাহুদুটি প্রসারিত করল এবং শ্রীল প্রভুপাদের দিকে ছুটে গেল, তারপরই থেমে গেল, মাথা নিচু করল এবং লজ্জা পেল। ভাবল যে, সে হয়তো তার সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। শ্রীল প্রভুপাদ নিচু হলেন, তার হাত ধরলেন, তারা দুজনে প্রভুপাদের ভবনের দিকে হাঁটতে লাগল, ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভাঙল এবং পুরনো বন্ধুর মত গল্প করতে লাগল।
প্রভুপাদ তাঁর রুমের পাশের প্রকোষ্ঠে রাধাকৃষ্ণের কিছু বিগ্রহ স্থাপন করেছিলেন। তিনি যমুনা মাতাজী এবং অন্যান্যদের বিগ্রহ পূজা অর্চনার পদ্ধতি শিখাচ্ছিলেন।
পুরুষোত্তম প্রভু বিগ্রহদের ভোগারতি দিলেন, ঘন্টা বাজালেন যখন শ্রীল প্রভুপাদ সরস্বতীর সাথে মজা করছিলেন। হঠাৎ সরস্বতী যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল এবং প্রভুপাদ তার দিকে একটি গাঁদা ফুল ছুঁড়ে দিল, যেটি তার মাথায় গিয়ে লাগল। সরস্বতী ফুলটা নিল, ফুলটা নিয়ে প্রভুপাদের কাছে এলো এবং তার প্রসারিত হাতের দ্বারা ফুলটি প্রভুপাদের মুখে ঢুকিয়ে দিল। ঠিক তখনি আমি সেখানে আসলাম এবং হেসে ফেললাম।
প্রভুপাদের সেই বড় বড় বিস্ফোরিত চোখ আর তার মুখে কমলা রঙ্গের গাঁদা। আমি সরস্বতীকে তার প্রিয় খেলনাটি দিলাম একটি ছোট গোপাল পুতুল যা সে সিঁড়িতে ফেলে এসেছিল এবং বললাম সরস্বতী, প্রভুপাদকে তোমার নতুন ছোট গোপালের পুতুলটা দেখাও। সরস্বতী প্রভুপাদকে তার ছোট্ট পুতুলটা দিল। প্রভুপাদ পুতুলকে আদর করল। সরস্বতী আমার কাছে এল এবং পুতুলের থেকে তার চোখ সরিয়ে নিল। শ্রীল প্রভুপাদ সরস্বতীর হাতের মুঠো তার পিঠের দিকে নিয়ে গেলেন এবং বললেন, “সরস্বতী, কৃষ্ণ কোথায়?” সে ডেস্কের চারদিকে নিচে এবং রুমের চারদিকে তাকাল এবং প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে প্রভুপাদের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, প্রভুপাদ এর কাছে কৃষ্ণ আছে। তার ছোট হাতে সে প্রভুপাদের ধুতির ভাজে পুতুলটি খুঁজতে লাগল এবং প্রভুপাদ খুব হাসতে লাগলেন। তারপর তিনি নিচু হলেন এবং পুতুলটি বের করলে সরস্বতী সেটি নিল, চিৎকার করলো এবং রুম থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। আমরা সকলেই নির্বাক হয়ে রইলাম এবং খুব হাসতে লাগলাম। ভক্তদের কাছে ইতিহাস ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে ও বেশি কিছু প্রকাশ করে। সত্যিই “প্রভুপাদের কাছে কৃষ্ণ আছে।”

ভারতে শ্রীল প্রভুপাদের সাথে

১৯৭০ এর সেপ্টেম্বর এর ২০ তারিখ শ্রীল প্রভুপাদের কাছ থেকে একটি চিঠি আসলো। লন্ডনের ভক্তরা উৎসাহী ছিলো; কিন্তু খুব কম ভক্তই ছিলো প্রভু শ্যামসুন্দর এবং মাতাজী মালতীর মতো উৎসাহী। সেই চিঠিতে শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করলেন। তিনি চাইছেন ২০ জন ভক্ত ভারতে আসুক তাঁর সাথে থাকার জন্য্ এবং প্রভু শ্যামসুন্দর এবং মাতাজী মালতী সেই বিশ জনের মধ্যে রয়েছেন। মাতাজী মালতী বলছেন, আমি ব্যারি প্লেস ইস্‌কন মন্দির এ ছিলাম এবং কেউ একজন এই চিঠিটি নিয়ে আসলো যেখানে প্রভুপাদ আমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন ভারতে যাওয়ার জন্য। তিনি বিশজন ভক্তের নামের তালিকা দিলেন। আমরা তার মধ্যে ছিলাম এবং তিনি (প্রভুপাদ) নিজের হাতে লিখেছেন এবং তালিকাতে শিশু সরস্বতী, গৌরদাস এবং যমুনা দেবী ও ছিলেন।
মুকুন্দ এবং জানকী মাতাজী রয়ে গেলেন ইংল্যান্ডর মন্দিরটি অন্যান্য ভক্তের সাথে তত্ত্বাবধানের জন্য সরস্বতীর তখন দু’বছর বয়স। প্রভুপাদের ব্যক্তিগত নির্দেশে তিনি যাত্রা করেছিলেন পুণ্য ভূমি ভারতে। যখন তাঁরা পৌঁছালেন তখন তাঁরা ছিলেন মুম্বাই আর প্রভুপাদ ছিলেন কলকাতায়। কিন্তু একটি ভাবনা তাঁদের বন্ধনকে আরও মধুর করেছিলেন যেটি হল একটি বছর তারা তাদের গুরুকে দেখেনি এবং এখন তাঁরা উভয়ই একই শহরে যদিও হাজার মাইল দূরে। তাঁরা শ্রীল প্রভুপাদের উপস্থিতির জন্য অপেক্ষা করতে পারছিলেন না। যাহোক, শ্যামসুন্দর প্রভু মুম্বাই এ প্রভুপাদের পক্ষে প্রচারের জন্য তাঁর পরিকল্পনা সুগঠিত করলেন। শেষ পর্যন্ত সবকিছুই ছিলো ভগবান কৃষ্ণের ইচ্ছা পশ্চিমা বৈষ্ণবরা প্রচার করছিলেন।
মুুম্বাইয়ের লোকেরা শ্যামসুন্দরের উপস্থিতির ব্যাপারে আগ্রহী ছিলো এবং তিনি শ্রীল প্রভুপাদকে লিখলেন তাঁর করণীয় সম্পর্কে তাঁকে লিখার জন্য। শ্রীল প্রভুপাদ যিনি কখনই কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের সুযোগ হারাতেন না শীঘ্রই সেখানে গেলেন বৃহৎ পর্যায়ে কাজ করার জন্য। বাস্তবিকই তাঁর পৌঁছানোর কিছুকাল পরেই তাঁরা খুব কম বিশ্রাম নিয়ে একটার পর একটা সার্বজনীন অনুষ্ঠান করতে থাকলেন।
একটি আগেরটির চেয়ে বড় আঙ্গিকে, এই সব ভূমিকায় শ্রীল প্রভুপাদ বিচক্ষণভাবে সরস্বতীকে যুক্ত করলেন সহজ সরল হাস্যরসের মধ্য দিয়ে কিন্তু কার্যকরভাবে এবং নিশ্চয়তা দিচ্ছিলেন যে কোন সংবেদনশীল প্রাণকে কৃষ্ণভাবনামৃতের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য, শ্যামসুন্দর লিখেছেন এই সম্মেলনগুলোতে সরস্বতীর কাজ ছিল ভজন এবং নৃত্য করা এবং শ্রীল প্রভুপাদ তাঁকে (সরস্বতীকে) নিজের গাড়িতে নিতেন।
সরস্বতী সব অনুষ্ঠানে প্রায়ই তাঁর কোলে বসতেন। সরস্বতী শীতলতা ভেঙে ভারতের মন গলাতে সক্ষম হলো এবং শীঘ্রই মুম্বাই থেকে সবার ভালবাসার পাত্রী হয়ে উঠলেন। ১৯৭১, পুরোটাই সরস্বতী ভারতে ছিলেন। যার জন্য প্রভুপাদের ঐ বছর নভেম্বরের ঐতিহাসিক পুণ্যভুমি বৃন্দাবন পরিক্রমায় সে সাথেই ছিল; যেটি ছিল ১ম পশ্চিমা ভক্তদের কৃষ্ণের জন্মস্থান পরিক্রমা।
শ্যামসুন্দর স্মৃতিচারণ করেছেন: প্রভুপাদ বাড়ী এলেন। এইখান থেকেই হরে কৃষ্ণ আন্দোলনের সূত্রপাত। এইটাই সেইস্থান যেখানে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে শক্তি দিয়েছিলেন পশ্চিমে যাওয়ার জন্য এবং সরস্বতী ছিলেন তাঁর প্রিয়জনদের মধ্যে অন্যতম। প্রভুপাদ যেখানেই যেতেন সরস্বতী তাঁকে অনুসরণ করতেন। মাঝে মাঝে শ্রীল প্রভুপাদ ছোট্ট সরস্বতীর হাত ধরতেন এবং তাঁর সাথে হাঁটতেন। সকল আটটার মধ্যে সরস্বতী প্রভুপাদের কক্ষে না এলে প্রভুপাদ জিজ্ঞাসা করতেন, সরস্বতী কোথায়? এবং বলতেন প্রতিদিন সকালে আমি ওকে দেখতে চাই; প্রায়ই তিনি সরস্বতীর সাথে মজা করতেন। মজা হাসানো বা কাঁদানোর জন্য, কিন্তু তিনি সরস্বতীকে সব সময় আনন্দ দিতেন এবং মিষ্টি প্রসাদ দিতেন।
প্রভুপাদের মিশন খুব দ্রুতই সম্প্রসারিত হতে লাগলো এবং তিনি শ্যামসুন্দরকে আহ্বান করলেন ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে তাঁর সাথে পুরো জগত ঘুরার জন্য; যদিও তাঁর স্ত্রী এবং কন্যা ভারতেই ছিলেন। এজন্য জানুয়ারি ১৯৭১ এর শেষের দিকে তাঁরা রাশিয়ার উদ্দেশ্যে ভারত ত্যাগ করলেন।
যদিও প্রভুপাদ সেখানে বেশিদিনের জন্য ছিলেন না কিন্তু তিনি চিরকালের জন্য পূর্ব ইউরোপের চেহারা পাল্টে দিলেন। আজকে এই আন্দোলনের যে প্রসার সেখানে হয়েছে তা শুধু সম্ভব হয়েছে প্রভুপাদের সেখানে কিছু সময়ের অবস্থানের জন্য। মস্কো থেকে তাঁরা প্যারিসে গেলেন এবং সেখান থেকে সান ফ্রান্সিসকো। তারপর তাঁরা নিউইয়র্ক গিয়ে লন্ডনে ফিরে আসলেন (শ্যামসুন্দর আনন্দিত হচ্ছিলেন তা দেখে যে, কিভাবে প্রভুপাদের উপস্থিতি এই আন্দোলনকে প্রসারিত করছিলো)। তাঁরা কেনিয়ায়ও গেলেন যেখানে সেখানকার স্থানীয়রা হরে কৃষ্ণ আন্দোলন স্থাপনের জন্য চেষ্টা করছিলেন। যাই হোক, চার মাস পর দিল্লীতে আরো একবার শ্যামসুন্দর তাঁর স্ত্রী এবং কন্যার সাথে মিলিত হলেন।
গুরু দাস, প্রভুপাদের প্রথমদিকের শিষ্যদের একজন, স্মৃতিচারণ করলেন দিল্লীর এক অনুষ্ঠানে ছোট্ট সরস্বতীর ভূমিকার কথা। এটা একটা সাফল্য ছিল যা আপনি কল্পনা করতে পারেন। কন্টে প্লেস, যেটি ছিল লন্ডনের মতোই আক্ষরিক অর্থে দিল্লীর দিকে যাওয়া সব রাস্তার সংযোগস্থল। এটির উত্তরে ছিল সংসদ ভবন এবং সচিবালয় পশ্চিমে ছিল সচিব, উচ্চপদস্থ ব্যক্তি এবং ধনীদের থাকার জন্য আবাসিক এলাকা।

প্রত্যেকেই উৎসবটিতে এসেছিল। যতদূর দেখা যায় লোকে লোকারণ্য। আমি অচ্যুতানন্দ, দীননাথ এবং অন্যান্যরা প্রভুপাদের সাথে স্টেজে বসে কীর্তন করছিলাম। অচ্যুতানন্দ দিক নির্দেশনা দিচ্ছিলেন এবং তখনই অন্যরকম কিছু একটা ঘটলো। ছোট সরস্বতী তখন তিন চার বছরের বেশী না; সে প্রভুপাদের সামনে গেল এবং দর্শকদের দিকে তাকালো এবং সবাইকে দাঁড়িয়ে নৃত্য করার জন্য ইশারা দিলো, আপনি কিভাবে একটি শিশুকে না বলবেন?
সুতরাং তার দর্শকরা তাঁর ইশারায় নৃত্য শুরু করলেন। এখনকার চেয়ে তখন ভারতীয়রা আরও বেশি রক্ষণশীল ছিলেন। অনুষ্ঠানে নৃত্য করা তারা পছন্দ করতেন না। তারপরও তারা নৃত্য করলেন এবং সবাই ছিলেন দিব্য আনন্দে মত্ত, প্রভুপাদের সমুদ্রের মতো গভীর হাসি এসব কিছুর আনন্দ আরো বাড়িয়ে দিয়েছিলো। তিনি খুবই আনন্দিত হলেন। শ্যামসুন্দর লিখেছেন; সরস্বতী ছিল প্রত্যেক অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ। সে স্টেজে প্রভুপাদের চোখের ইশারায় নৃত্য করতো।
তিনি হাসতেন, যখন সরস্বতী স্টেজে ঝাঁপিয়ে পড়তেন এবং দর্শকদের আরো আনন্দের দিকে নিয়ে যেতেন, সে রাজস্থানী পোশাক পড়তো। গায়ের রং এর চুমকি ও কাঁঠ বসানো কারুকার্য করা জামা স্কাট। প্যান্ডেল এর একদিকে জনপ্রিয় প্রশ্ন উত্তর বুথ ছিল। যেখানে একজন বয়স্ক ভক্ত, অনেক উঁচু এক ব্যাস আসনে বসতেন এবং জনসাধারণের প্রশ্নের উত্তর দিতেন। সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত প্রায় তিন থেকে চারশত ভক্ত দর্শনার্থী এই বুথের চারপাশে দাঁড়াতো এবং তমাল কৃষ্ণ প্রভু বা গুরুদাস বা ঋষি কুমারকে প্রশ্ন করত আর এসব চলতো মধ্যরাতের অনেক পর পর্যন্ত। সরস্বতীর কাছে প্রভুপাদের সঙ্গে কাটানো সময় গুলো সহজভাবেই পরিবর্তিত হয়েছে।
সর্বোপরি, শ্রীমদ্ভাগবত (১১/২/৩০) এ বলা আছে যে শুদ্ধ ভক্তের ক্ষণার্ধকালের সঙ্গও অমূল্য রতন স্বরূপ। শ্রীচৈতন্য-চরিতামৃতে (মধ্য খণ্ড ২২/৫৪) ভগবান শ্রীচৈতন্য এই কথাকেই নিশ্চিত করে বলেছেন যে, শুদ্ধ ভক্তের সঙ্গের মাধ্যমে একজন মানুষ তার জীবনের পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তুমি তোমার জীবনে রাখ

শুধু কয়েক বছরেই সরস্বতী অনেক ধরনের জীবনযাপন করেছে। তার বয়স যখন পাঁচ বছর হল, তখন তাকে স্কুলে ভর্তি করানোর সময় এল। তার মা বাবা জানত তার ভবিষ্যতের জন্য একটি স্থিতিশীল প্রভাব দরকার ঘরে একটি সুন্দর ভিত্তি এবং একটি ভাল স্কুলে নিয়মিত উপস্থিতি প্রভুপাদ তাকে উৎসাহিত করলেন সে বিষয়ে।
শ্যামসুন্দর প্রভু স্মৃতিচারণ করেছেন, “অশ্রুসজল চোখে আমি ওকে ডালাসের ভাল নতুন গুরুকুল স্কুলে রেখে এলাম, এটি ছিল ১৯৭৩ সালের প্রথম দিককার সর্বজনস্বীকৃত ইস্‌কনের একটি বোডিং স্কুল।” কিন্তু শ্যামসুন্দর এবং মালতী দেবী সরস্বতীর অভাব খুবই অনুভব করতেন। পরবর্তী গ্রীষ্মের দিকে সে তার মা বাবার কাছে ফিলে এল। কিছু সময়ের জন্য তিনি মালতী দেবীর সাথে অধিক সময় ব্যয় করতেন; যিনি তার পড়াশোনার ব্যাপারে খেয়াল রাখতেন।
১৯৭৭ সালে প্রভুপাদ দেহত্যাগ করেন। এই সময়ের মধ্যে সরস্বতী একা শ্যামসুন্দরের সাথে আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলসে ফিরে আসেন, সেখানে তাকে কাজের জন্য যেতে হয়েছিল । শ্যামসুন্দর প্রভু সরস্বতীর জন্য স্থায়ী বাড়ি তৈরি করতে পেরেছিলেন। সেখানে তিনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন। তোপাঙ্গা, মাউন্ড বাল্ডি এবং আপল্যান্ড ক্যালিফোর্নিয়া থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং সাইকোলজি এর উপর তার পড়াশোনা শেষ করেন। এখন তার বয়স প্রায় পঞ্চাশ এবং তার নাম সারা। তিনি বিবাহিতা এবং দুই সন্তানের জননী। কিন্তু এখনও তিনি ভক্তদের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করে সরস্বতী বলেন:
শৈশবের দিনগুলোতে ইস্‌কনের প্রথম দিকের সময়ের একজন হওয়া আমাকে দেখিয়েছে আমরা সবাই একে অপরের সাথে যুুক্ত। মানুষ বাহ্যিক দৃষ্টিতে আলাদা ঠিকই কিন্তু তারপরও এক; যেখান থেকেই সে আসুক না কেন। আমরা সকলে একই জিনিস চাই। সমস্ত আপাততঃ ব্যবধানের মধ্যেও মানুষ আনন্দময় সত্তা, যুক্ত হয়ে আছে এক মৌলিক সত্তার সঙ্গে। তার প্রধান বিশ্বাস এখনও একই রকম আছে। তার বিবেচনায় আধ্যাত্মিক হওয়া মানে সমালোচক হওয়া নয়। এটি মানে উদার হওয়া, ক্ষমাশীল, প্রেমপূর্ণ হওয়া যেটা শ্রীল প্রভুপাদ আমার প্রতি ছিলেন।
তিনি আমাকে শিখিয়েছিলেন সমস্ত জীবকে ভালবাসতে, শিখিয়েছিলেন সত্যিকারের আধ্যাত্মিকতা নিহিত থাকে কর্মে এবং এই কাজটা করা যায় আধ্যাত্মিকভাবে উদ্দীপ্ত একটি কোমল হৃদয় দ্বারা।”
এটা তিনি শিখেছিলেন তাঁর কাছ থেকে; শুধুু তাঁর কথা থেকে নয় তাঁর আর্দশ থেকেও। সরস্বতী একজন নিরামিষভোজী; উদ্ভিজ্জ খাবারই পছন্দ করেন কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি এই গোল্ডেন রুলটির সমর্থক যে “অন্যদের সাথে সেটাই কর যেমনটা তুমি তাদের কাছ থেকে আশা কর।” এমন কিছু যেটা তিনি শৈশবে ভক্তদের করতে দেখতেন। তার দৈনন্দিন কাজকর্ম এবং অন্যদের প্রতি তাঁর ব্যবহারের মধ্য দিয়ে দেখাতে চেষ্টা করেন আধ্যাত্মিকা মানে কী।
পুরোজীবনেই সরস্বতী শ্রীল প্রভুপাদের দ্বারা উপকৃত হয়েছিলেন এবং তার শৈশবের দিনগুলোতে তার প্রতি প্রকাশ পেয়েছে প্রভুপাদের কৃপা। তার বর্তমান জীবনকেও এটি প্রভাবিত করছে। এটা স্মরণ রাখা দরকার যে, শৈশবে প্রভুপাদ ছিলেন তার সবচেয়ে ভাল বন্ধু এবং একজন ঐশ্বরিক খেলার সাথী এবং তার প্রতি সবসময় সদয় ছিলেন। “ সরস্বতী বলেন তাঁর কাছ থেকে আমি যা শিখেছি তা ভাষায় প্রকাশ করা যাচ্ছে না, এটা গঠন করেছে বর্তমান আমাকে, কিভাবে আমি জগৎকে দেখি এবং আমি জীবনে কোনটিকে মূল্য দেই”, সরস্বতী বলেন। তিনি এখনও জপ করেন সেই মহামন্ত্র

“হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে”

তার পরম আশ্রয়স্থল- যেটা তিনি প্রায়ই করেন তার অন্তরের প্রশান্তি ও তৃপ্তির জন্য। যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে তিনি একজন নিয়মিত সাধিকা নন, তিনি নিয়মিত কৃষ্ণের নাম নেন, কখনও স্পষ্টভাবে, কখনও অবচেতনভাবে। এটি তার কাছে সবসময়ই আছে। তিনি বলেন যে তাঁর কাছে এই নাম খোঁজা তার তরুণ বয়সে শ্রীল প্রভুপাদকে খুঁজে ফেরার মতোই। শ্রীল প্রভুপাদের স্মিত হাস্য মুখ অপরিসীম বিশেষ করে যখন এটি জড়িত একজন শুদ্ধ ভক্তের সাথে।
এটি সত্যি যে, শৈশবে তিনি ভক্তদের সঙ্গে তার পিতা মাতার সাথেই থাকতেন। কিন্তু একই সাথে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তেও ঘুরে বেড়িয়েছেন প্রায়ই বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা মানুষের সঙ্গে মিশেছেন যাদের তিনি চিনতেন না। প্রভুপাদের উৎসাহব্যঞ্জক স্মিত হাসি তাকে স্বস্তি দিত, এমনকি দিত ব্যক্তিগত আত্মবিশ্বাসও যেমনটা কেউ পেত একজন প্রবীণ বিচক্ষণ অনেকটা একজন যত্নশীল ঠাকুরদাদার সান্নিধ্যে।
তিনি বলেন, শ্রীল প্রভুপাদের হাসি তাকে সবসময়ই উজ্জীবিত করতো। আর যেহেতু তিনি ছিলেন প্রভুপাদ তাই তিনি এর থেকেও বেশি কিছু করতে পারতেন। তিনি তাকে সাহায্য করেছেন-এখনও কৃষ্ণকে স্মরণ রাখতে।


 

ব্যাক টু গডহেড অক্টোবর-জিসেম্বর ২০২১ প্রকাশিত

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।