এই পোস্টটি 262 বার দেখা হয়েছে
শ্রীশ্রী রাধা-গোবিন্দ মন্দির
আজ থেকে ৫০০০ বছর পূর্বে শ্রীবজ্রনাভ (ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রপৌত্র) উত্তরাদেবীর আদেশে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের তিনটি শ্রীবিগ্রহ নির্মাণ করেছিলেন। উত্তরাদেবীর বর্ণনা অনুসারে, বিগ্রহত্রয়ের মধ্যে শ্রীমদনমোহনের চরণযুগল, শ্রী গোপিনাথের বক্ষস্থল এবং শ্রী গোবিন্দের মুখারবিন্দ সাক্ষাৎ শ্রীকৃষ্ণের ন্যায় প্রকটিত হয়েছে। এই তিন শ্রীবিগ্রহের সম্মিলনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পূর্ণস্বরূপ প্রকটিত হয়েছে। আর এই কারণেই বৃন্দাবনে বহু বৈষ্ণব প্রতিদিন এই বিগ্রহত্রয়কে দর্শন করে থাকেন। শ্রীগোবিন্দদেবের মুখপদ্ম কোটি কন্দর্পের ন্যায় যা সকলকে আকর্ষিত করে। কিন্তু কালের প্রভাবে গোবিন্দদেবের বিগ্রহ হারিয়ে যায়। এরপর পতিত পাবন ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু আজ থেকে ৫০০ বছর পূর্বে নদীয়ায় অবতীর্ণ হয়ে বৃন্দাবনের অনেক লুপ্ত তীর্থস্থান পুনঃরুদ্ধার করেন। এছাড়া তিনি তাঁর অন্তরঙ্গ পার্ষদ শ্রীরূপ সনাতন সহ ষড়গোস্বামীদের বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের শ্রীবিগ্রহসহ সমস্ত তীর্থস্থান উদ্ধারের নির্দেশ দেন।
শ্রীশ্রী গোবিন্দদেব জীউ এর প্রকট লীলা : শ্রীরূপগোস্বামী একদিন যমুনাতটে বসে মনে মনে মহাপ্রভুর কথা ভাবছেন ও বলছেন—–“প্রভুর আদেশ কিছুই পালন হল না, এ জীবন ধিক? এরূপ বলতে বলতে অশ্রুবিসর্জন করছেন। অকস্মাৎ সেখানে এক গোপকুমার উপস্থিত হয়ে বললেন–স্বামিন! অশ্রুপাত করছেন কেন? আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি কোন গুরুতর চিন্তা করছেন ?
শ্রীরূপ গোস্বামী–হ্যাঁ গোপকুমার! আমি কিছু চিন্তান্বিত।
গোপকুমার–স্বামিন্। কি চিন্তা করছেন। গোপকুমারের চেহারা অতি মনোহর, কথাগুলি মধুর।
শ্রীরূপ–তোমাকে বললে কি হবে?
গোপকুমার–হ্যাঁ নিশ্চয় সফল হবে?
শ্রীরূপ–আমি মহাপ্রভুর নির্দেশে এখানে এসেছি। তিনি আমাকে শ্রীবিগ্রহসেবা প্রকাশ করতে বলেছেন। তা কি করে হবে তাই ভাবছিল।
গোপকুমার–স্বামিন! আমার সঙ্গে যাবেন?
শ্রীরূপ–তুমি কোথায় নিয়ে যাবে।
গোপকুমার–যেখানে নিয়ে যাই আপনি আসুন তো।
শ্রীরূপ–আচ্ছা চল।
গোপকুমারের এসব কথা শুনে শ্রীরূপ গোস্বামী একটু মনে মনে বিস্ময়ান্বিত হচ্ছেন। অকস্মাৎ গোপকুমার কোথা থেকে এল, একে তো দেখতে শুনতে ভাল লাগছে, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যেন মদনদেবের ন্যায় সুন্দর, কথাগুলি সুন্দর–মহাপুরুষের লক্ষণও প্রকাশ পাচ্ছে। শ্রীরূপ গোস্বামী গোপকুমারের সঙ্গে চলেছেন। ক্রমে এলেন গোমাটিলার নিকট।
গোপকুমার বললেন–স্বামিন! এ টিলাটি দেখছেন?
এ টিলার নাম ‘গোমাটিলা’-এর মধ্যে শ্রীগোবিন্দদেব আছেন। প্রতিদিন একটি কামধেনু এসে এ টিলাটিকে দুগ্ধধারায় স্নান করিয়ে চলে যায়। শ্রীরূপ গোস্বামী গোমাটিলাটিকে লক্ষ্য করতে লাগলেন; এদিকে গোপকুমার অন্তর্ধান হলেন। গোপকুমারের অন্তর্ধানে শ্রীল রূপ গোস্বামী মুর্ছিত হয়ে পড়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর চেতনা পেয়ে ভাবতে লাগলেন– নিশ্চয় সেই শ্রীগোবিন্দদের গোপকুমার রূপে আমাকে দেখা দিয়ে চলে গেলেন; আমি অভাগা, বুঝতে পারলাম না। পরদিন শ্রীরূপ গোস্বামী পূর্বাহ্নে সেখানে এলেন এবং দেখলেন সত্যই একটি কামধেনু এসে সেই টিলাটিকে দুগ্ধধারায় স্নান করিয়ে চলে যাচ্ছেন। তিনি এবার সবকথা বুঝতে পারলেন। গোস্বামিপাদ এবার আনন্দে ভরপুর হয়ে উঠলেন। তিনি শীঘ্রই গ্রামে এলেন এবং গোপগণকে ডেকে এসব কথা বললেন। তাঁরা শুনে খুব সুখী হলেন ও তৎক্ষনাৎ কোদাল-কুড়াল নিয়ে গোমাটিলায় এলেন এবং গোস্বামীর নির্দেশে খনন আরম্ভ করলেন। অল্প খনন করতেই অপূর্ব মূর্তি দর্শন হল, মূর্তিখানি কোটি কন্দর্পের রূপের দর্পহারী, নয়ন মনের আনন্দ বর্ধনকারী। আনন্দ ভরে গোপগণ মহা হরি হরি ধ্বনি করে উঠলেন। শ্রীরূপ গোস্বামী অশ্রুসজল নয়নে দণ্ডবৎ প্রণাম নিবেদন করলেন।
ব্রজবাসিগণ আনন্দ ভরে, ভারে ভারে দই, দুধ, চাল, তরি-তরকারী ও বিবিধ প্রকার অন্যান্য সামগ্রী আনতে লাগলেন। শ্রীরূপ গোস্বামীর কুটীরের নিকট ছোট একটি পত্রের গৃহ নির্মাণ করে সেখানে শ্রীগোবিন্দদেবের স্থাপন হল। শ্রীরূপ গোস্বামী এ সংবাদ তৎক্ষণাৎ অন্যান্য গোস্বামিগণের নিকট প্রেরণ করলেন। গোস্বামিগণ এ সংবাদ শ্রবণের পর আনন্দে উল্লসিত হয়ে নাচতে নাচতে সেখানে দ্রুত চলে এলেন। দর্শন মাত্র দণ্ডবৎ প্রণাম নিবেদন করে গোপালদেবের বন্দনা করতে লাগলেন। এরপর শ্রীল গোপালভা গোস্বামী অভিষেক কার্য আরম্ভ করলেন। অভিষেকের সময় সবাই আনন্দে নৃত্য-গীত করতে লাগলেন। তারপর রাজভোগ নিবেদন করা হল ও প্রসাদ বিতরণ করা হল। শ্রীলরূপ গোস্বামিপাদ একজন ভক্তকে পত্র লিখে পুরীতে মহাপ্রভুর নিকট পাঠালেন। সংবাদ শুনে মহাপ্রভু ও ভক্তগণ আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠলেন। মহাপ্রভু গোবিন্দদেবের সেবা করার জন্য শ্রীকাশীশ্বর পণ্ডিতকে বৃন্দাবনে পাঠালেন। তিনি শ্রীগোবিন্দদেবের সেবার দেখাশুনা করতে লাগলেন।
মন্দির নির্মাণঃ শ্রীল রূপগোস্বামী প্রথমে একটি ঝুপরিতে রেখে তার মধ্যে শ্রীগোবিন্দদেব জীউর সেবা করতেন। এরপর শ্রীরঘুনাথ ভট্ট গোস্বামী তাঁর শিষ্য মহারাজ মানসিংহকে গোবিন্দদেবের মন্দির নির্মাণ করতে আদেশ দেন। শ্রীল রঘুনাথ ভট্ট গোস্বামী ও মানসিংহের তত্ত্বাবধানে মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু হয় উচু পাহাড়ের উপরে গোমাটিলায়, যেখানে শ্রীগোবিন্দদেবের বিগ্রহ পুনঃরূদ্ধার হয়েছিল। এই মন্দিরটি ছিল বৃন্দাবনের সবচেয়ে উঁচু মন্দির (৭ তলা), যার নির্মাণ কাজ ১৫৯০ সালে শেষ হয়। এই মন্দিরের সর্ব্বোচ্চ গম্বুজে আড়াই মন ঘি-যুক্ত একটি আলো সব সময় জ্বালানো থাকত। একবার তৎকালীন দিল্লীর সম্রাট আওরাঙ্গজেব ঐ আলো দর্শন করে আক্রোশ বশতঃ তা ভাঙ্গবার জন্য সৈন্যদেরকে আদেশ দিলেন। তারা মন্দিরে এসে ভাংচুর শুরু করলে মন্দিরের সন্নিকটে অবস্থিত শ্রীহনুমানজী দলবল সহ তাদেরকে আক্রমন করলেন। এমন অবস্থায় মন্দিরের তিন তলা পর্যন্ত কোনভাবে ভেঙ্গে সৈন্যগণ সেই স্থান হতে পালিয়ে যায়। সেই ভগ্ন মন্দির এখনো বৃন্দাবনে দর্শন করা যায়। পরবর্তীতে আরও উৎপাত আরম্ভ হবে তা বুঝতে পেরে ভক্তগণ শ্রী গোবিন্দ বিগ্রহকে জয়পুরে স্থানান্তরিত করেন। পরবর্তীতে পুরাতন মন্দিরের পার্শ্বে নতুন মন্দির স্থাপন করা হয় যেখানে শ্রী গোবিন্দদেবের অভিন্ন প্রতিভূ বিগ্রহ বিরাজিত রয়েছেন। শ্রীগোবিন্দের বামে শ্রীমতি রাধারানী এবং ডানে ললিতা সখি বিদ্যমান।
এই ভুবন মোহনীয় শ্রী শ্রী রাধাগোবিন্দকে কে না দর্শন করতে চায়। সুতরাং আপনারা আপনাদের এই দুর্লভ মানব জীবনকে সফল করতে বৃন্দাবনে তীর্থ দর্শন করে শ্রী শ্রী রাধা গোবিন্দের অপরিসীম কৃপা লাভ করুন। হরেকৃষ্ণ।