এই পোস্টটি 934 বার দেখা হয়েছে
![গুণ্ডিচা মার্জন](http://csbtg.org/wp-content/uploads/2019/07/lord-chaitanya-clean-the-temple-gundicha-e1562139627697.jpg)
৪মিনিট লাগবে পড়তে
শ্রীল জয়পতাকা স্বামী।
” ভক্তেরা সর্বদাই মায়ার ভয়ে ভীত। ভক্তেরা তবে কি করেন? শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু আমাদের সেটির দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করেছেন, যখন তিনি জগন্নাথপুরীতে গুণ্ডিচা মার্জন লীলা করেছেন। তিনি তাঁর সকল ভক্তদের সেখানে নিয়ে গেলেন। সেখানে তখন অনেক খড়কুটো, পাতা এবং আবর্জনা পড়ে ছিল। তিনি সবাইকে বললেন, ‘এই সবকিছু জড়ো কর।’ এবং তিনি নিজেই পাতা, খড়কুটো কুড়াতে শুরু করলেন, সেগুলো তাঁর বস্ত্রে রাখলেন। তাঁর নিজের বস্ত্রে!
প্রীতিভরে তিনি সেই মন্দিরটি মার্জন করলেন। তিনি তাঁর সকল ভক্তদের বললেন, ‘কে বেশি বেশি এসকল খড়কুটো এবং পাতা কুড়াতে পারবে? আমরা এগুলো সব জড়ো করে বাইরে নিয়ে যাব এবং দেখব কে এসকল আবর্জনা সবচেয়ে বেশি জড়ো করেছে।’
সেখানে এক চিন্ময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল: কে বেশি ভালো এবং উদ্যমের সাথে মন্দির মার্জন করতে পারে।
তাই, সবাই সেখানে মন্দির মার্জন করছিল যতক্ষণ না পর্যন্ত মন্দিরটি খড়কুটো থেকে পুরোপুরি পরিষ্কার না হচ্ছে। তখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর ধুলির স্তুপ ভূমিতে রাখল। সবাই অবাক হয়ে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ধূলির স্তুপ দেখল এবং আবিষ্কার করল, তাঁদের ধূলির স্তুপ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর তুলনায় কত সামান্য! তারপর তাঁরা তাঁদের সবার স্তুপ একত্র করল, এবং দেখল তাঁদের সকলের সন্মিলিত স্তুপও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর তুলনায় কিছুই না। তিনি এতটা উদ্যমের সাথে সন্মার্জন করেছেন, যা প্রতিপন্ন করে যে কৃষ্ণ স্বয়ং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু রূপে অবতীর্ণ হয়েছেন, কিভাবে যথার্থ ভক্ত হতে হবে আমাদের সেটি প্রদর্শন করার জন্যে।
এসকল পাতা এবং খড়কুটো হল বিভিন্ন জাগতিক কামনা-বাসনা, আমাদের হৃদয়ে স্থূল কামের মত, এদের থেকে হৃদয়কে পরিষ্কার করতে হবে। আমরা বলে থাকি যে আমাদের দেহ হচ্ছে এক মন্দির, এবং আমাদের হৃদয় হল গর্ভগৃহ, রাজধানী, হৃদয় হল রাজধনীর সমতুল্য। তাই রাজধানীর সকল আবর্জনা আমাদের পরিষ্কার করতে হবে।
কিন্তু সেখানেই সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি, আমরা জানি যে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু একটি সন্মার্জনী নিয়ে ফিরে এলেন এবং তারপর তিনি মন্দির ঝাড়ু দিতে শুরু করলেন। তখন সকল ভক্তবৃন্দ মন্দির ঝাড়ু দিতে শুরু করল এবং পড়ে থাকা সব ছোট ছোট ঘাসের টুকরোগুলোও পরিষ্কার করা হল। এটি ততক্ষণ চলল যতক্ষণ না পর্যন্ত মন্দিরটি সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয়েছিল। সারা মন্দির, প্রত্যেকটি কোণা এবং খাজ ঝাড়ু দেয়া হয়েছিল এবং এরপরেও তা শেষ হলনা।
আবারো, ভক্তেরা জলপাত্রে জল নিয়ে প্রস্তুত হল। তখন মহাপ্রভু জলপাত্র আনতে বললেন এবং নিজে জল নিয়ে মেঝেতে, প্রাচীরে এবং সিংহবেদীতে ঢালতে লাগলেন।
তাঁরা ভোগ মন্দির, প্রসাদ কক্ষ পরিষ্কার করলেন এবং মন্দির প্রাঙ্গণ, নাটমন্দির, কীর্তন কক্ষ- সর্বত্র পরিষ্কার করলেন। শত শত ভক্ত সরোবর থেকে, কুণ্ড থেকে জল নিয়ে আসছিল এবং মাঝে মাঝেই পাত্রে পাত্রে সংঘাত হওয়ায় তাঁদের কলস ভেঙে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে তাঁরা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর চরণকমলে জল নিক্ষেপ করছিল এবং গোপনে সেই জল, সেই চরণামৃত আস্বাদন করছিল। এবং তখন একজন ভক্ত এমন অবস্থায় হাতেনাতে ধরা পড়ল এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু স্বরূপ দামোদর কে ডাকলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই গৌড়ীয়া কে? তুমি তোমার গৌড়ীয়া ভক্তদের সামলাও! আমি যখন গর্ভগৃহে ছিলাম সে তখন আমার পদধৌত জল পান করছিল। এটি মস্তবড় অপরাধ!’ তখন স্বরূপ দামোদর তার ঘাড় ধরে বলল, ‘তুমি করেছ টা কী!’ এবং তাকে মন্দিরের বাইরে পাঠিয়ে দিল।
শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন যে স্বরূপ দামোদর ছিলেন সকল গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের তত্ত্বাবধায়ক। একারনেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছিলেন, ‘তোমার গৌড়ীয়া।’ কোন কোন ভক্ত নির্দিষ্ট এলাকার ভক্তবৃন্দের তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত ছিলেন, যেমন স্বরূপ দামোদর ছিলেন গৌড়ীয় ভক্তদের তত্ত্বাবধায়ক, রূপ এবং সনাতন বৃন্দাবনের লক্ষ্য রাখছিল। এভাবে বিভিন্ন ভক্তেরা বিভিন্ন সেবায় নিযুক্ত ছিলেন। শিবানন্দ সেন ভক্তদের বাংলা থেকে নিয়ে আসতেন, কিন্তু বাংলা তথা গৌড়ীয় ভক্তদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন স্বরূপ দামোদর।
এভাবে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এক যথার্থ বৈষ্ণবের দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করেছেন, যদিও তিনি ছিলেন স্বয়ং কৃষ্ণ। মনে মনে তিনি সেই ভক্তের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছিলেন কিন্তু বাহ্যিকভাবে তিনি এরকম অপদৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাননি যে তিনি গর্ভমন্দিরে সিংহাসন পরিষ্কার করছেন এবং অন্য কেউ তাঁর পাদপ্রক্ষালন করছে, পাদোদক পান করছে এবং সবাই তা দেখছে। তাই জল দ্বারা সর্বত্র পরিষ্কার করার পর মন্দিরটি যেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর হৃদয়ের মত পরিশুদ্ধ প্রতিভাত হচ্ছিল- এতটা শুদ্ধ এবং পবিত্র।
কিন্তু এরপর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু পুনরায় মন্দিরে ফিরে এলেন এবং সবাই মিলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফাটল, সকল পাথর গুলোও পরিষ্কার করতে লাগলেন, তাঁদের নখের মাধ্যমে তাঁরা ভাজে ভাজে লুকিয়ে থাকা সর্বশেষ ধূলিকণাটিও তুলে আনলেন।
তাঁরা কতটা নিখুঁতভাবে পরিষ্কার করছিলেন তা আমাদের বুঝা খুবই প্রয়োজন, কেননা পুরঞ্জনের রূপকের মত গুণ্ডিচা মন্দির মার্জনেরও এক রূপক অর্থ রয়েছে….
চারটি বিধিনিষেধ পালনের পর আমরা মানসিক প্রজল্প থেকে মুক্তি পাই, এরপর আমরা এসব সুক্ষ্ম কামনার হাত থেকে মুক্ত হই এবং আমরা এসব কামনা বর্জন করলেও আমাদের বারবার খুজে বের করতে হবে যে এখনো কোথায় আমাদের বিষয়ী মনোবৃত্তি লুকিয়ে আছে, জাগতিক কামনার লেশমাত্র কোথায়। এরপর আমাদের লক্ষ্য করতে হবে যে শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন, কেউ যদি ইন্দ্রিয় তৃপ্তির বাসনা পরিত্যাগও করে, আমাদের সকাম কর্মের উপর দৃঢ় আকর্ষণের জন্যে আমরা ভাবি যে আমাদের কঠোর পরিশ্রম এবং উদ্যমের জন্যে আমরা কিছু না কিছু কর্মফল, কিছু ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করবই। এমনকি মাঝে মাঝে ভক্তেরা ভালো উদ্দেশ্য নিয়েই কোন ব্যাবসা কিংবা কাজে জড়িয়ে পড়ে এবং প্রাপ্ত অর্থ কৃষ্ণকে নিবেদন করে, কিন্তু তাঁরা যদি সতর্ক না থাকে তবে তাঁরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও সকাম মনোবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ে এবং কৃষ্ণকে নিবেদন করা তাঁরা ছেড়ে দেয়। যার ফলে তারা কেবল সকাম কর্মী হয়ে পড়ে, জাগতিক চেতনায় অধঃপতিত হয়। তাই আমাদের কেবল স্থূল ইন্দ্রিত তর্পণের আকাঙ্ক্ষা দূর করলেই চলবেনা- ‘না, আমি ইন্দ্রিয় তর্পণ করতে চাইনা, আমি কর্মফল উপভোগ করতে চাই না’, আমাদের সুক্ষ্ম মানসিকতা গুলোও দূর করতে হবে। এটা কোন স্থান পরিষ্কার করার পর থেকে যাওয়া গন্ধের মত, আবর্জনা পরিষ্কার করার পরও আপনি সেই স্থানে গেলে আবর্জনার গন্ধ যেমন পান, তেমন। আমাদের হৃদয়ের এই আবর্জনার শেষ গন্ধটুকুও নির্মূল করতে হবে। এর অর্থ, আমাদের সর্বদা বিনম্র হতে হবে। আমরা যদি গর্বিত হই এই ভেবে যে, ‘আমাদের হৃদয় পরিশুদ্ধ, আমি এটা করতে সক্ষম হয়েছি’, তাহলে আমাদের হৃদয়ের খাজে খাজে এই আবর্জনা জমে থাকবে যা আমরা এখনও পরিষ্কার করিনি।
যদি আমরা বিষয় বাসনার গন্ধ থেকে পূর্ণ পরিশুদ্ধ হতাম, আমরা তবে কৃষ্ণকে দেখতে পেতাম, তাঁর সাথে কথা বলতে পারতাম। কৃষ্ণের কথা শ্রবণের সাথে সাথে আমাদের হৃদয় দ্রবীভূত হত। এটা পাথরের মত কঠিন থাকত না। এমনকি হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপের পরও আমাদের হৃদয় বিগলিত না হয়ে সুস্থির থাকতে পারত না, এটা অবশ্যই বিগলিত হত। তাই, হৃদয় পরিশুদ্ধকরণে আমাদের খুবই সতর্ক হতে হবে। ”
শ্রীল জয়পতাকা স্বামী গুরুমহারাজ।
১৬ই জুন, ১৯৮১।
লস এঞ্জেলস।