
চৈতন্য চরণ দাস: বিশ্বকাপ ক্রিকেট উন্মাদনা এখন প্রায় সব খানেই। সবদিকে কেমন জানি সাজ সাজ রব আর উত্তেজনা। বলা হয়ে থাকে ক্রিকেট মানেই একটি উত্তেজনা খেলা। ২২জন ক্রিকেটার প্রতি মূহূর্তে দর্শকদের উত্তেজনায় রাখতে সচেষ্ট। কিন্তু এক্ষেত্রে যেটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাড়ায় তা হল ব্যাট ও বলের মধ্যে খেলোয়াড় ও দর্শকের প্রধান বস্তু হল বলটি। বলটিকে বেধড়ক পেটানো হয় আবার মাঝে মাঝে চুম্বন করা হয়। মাঝে মাঝে এটি খুব উঁচুতে উঠে আবার মাঝে মাঝে একেবারে মাঠ ঘেঁষে ঘেঁষে চলে। মাঝে মাঝে তাকে থ্রো বা ছুড়ে মারে। একটু ভেবে দেখুন, আমাদের জীবনটা ও কি এই বলের মত নয়? বলের মত আমাদেরকেও মাঝে মাঝে সবাই ভালবাসে আবার ঘৃনা করে। অনেক সময় আমাদের জীবন সফল হওয়ার মাধ্যমে সুউচ্চ অবস্থান করে আবার অনেক সময় একেবারে ডাঙায় নেমে আসতে বাধ্য হয় ব্যর্থতার পরিহাসে। মাঝে মাঝে কেউ কাছে টানে। মাঝে মাঝে আবার কেউ ঐ বলটির মত খেলা শেষ হলে চরম অবহেলা করে। জীবনের খেলায় এটি যেন এক চরম বাস্তবতা। খেলায় বলটি হয় শুধুমাত্র সবার মনোযোগের বস্তু। পক্ষান্তরে এটি সবার ভালবাসার বস্তু নয়। খেলোয়াড়েরা (এবং দর্শকেরা) এই বলটির প্রতি সমস্ত মনোযোগ ঢেলে দেয় শুধুমাত্র একটি আশায় যাতে করে তারা যা চায় তাই পায়। অনুরূপভাবে আমরাও মাঝে মাঝে অন্য মনোযোগের কারণ হই, কিন্তু আমরা কি তাদের ভালোবাসার বিষয় হই? অপ্রিয় সত্য এই যে, অধিকাংশই আমাদের প্রতি আগ্রহী হয় না, বরং আমাদের কাছ থেকে তারা কি পাবে সেটার প্রতিই তাদের যত আগ্রহ। খেলা শেষে বলটিকে বেদম পেটানোর পর যখন বলটির চাকচিক্য দূর হয়ে যায়, তখন সেটিকে রাখা হয় কোন এক পরিত্যক্ত স্থানে। কেউ আর বলের খোঁজ করে না। একইভাবে যখন আমাদের শরীর বয়সের ভারে নুইয়ে পড়ে তখন আমাদেরকে অবসর দেয়া হয় বা ছুড়ে ফেলা হয়। আমরা তখন ঘরের কোণে কোন রকমে দিনাতিপাত করি। দল জেতে আবার দল হারেও, কিন্তু বল, বল কখনো জেতে না। এটিকে শুধুই বেধড়ক পেটানো হয়। একইভাবে আমাদের শরীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সংঘ, দেশ ইত্যাদির সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও মাঝে মাঝে হারে বা জেতে কিন্তু আমরা আত্মা হিসেবে দেহগত দুঃখদুর্দশা, সামাজিক দুঃখদুর্দশার মাধ্যমে সবসময় পরাজিত হই। একটি দিক থেকে আমরা ঐ ক্রিকেট বল থেকে ভিন্ন বা স্বাধীন। তা হল বলটি শত চেষ্টা করেও তাকে পেটানোর খেলাটি থামাতে পারে না, কিন্তু আমরা পারি। আমাদের সেই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। বৈদিক শাস্ত্রে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, খেলাধুলার প্রতি আমাদের যত আগ্রহ তা স্বাভাবিক প্রবণতা কিন্তু জড়জগতে এটি ভুল দিকে পরিচালিত হচ্ছে। নিত্য চিন্ময় আত্মা হিসেবে জাগতিক জীবনের দুঃখ দুর্দশাময় খেলায় অংশগ্রহণ বেমানান। আমাদের কর্তব্য পরম জনপ্রিয় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দলে অংশগ্রহণ করে নিত্য খেলা উপভোগ করা। ভগবদ্ধাম হল সেই খেলার ভেন্যু। যেখানে কৃষ্ণ তার অন্তরঙ্গ ভক্তদের সাথে প্রেমময়ী খেলা উপভোগ করে। যেখানে, “প্রতিটি হাঁটাও এক একটি নৃত্য। প্রতিটি কথাই এক একটি গান। (শ্রী বৃক্ষ-সংহিতা) সেখানে চিন্ময় খেলাধুলা উপভোগের জন্য সমস্ত বাসনাই পূর্ণ হয়। সেটি কাল্পনিকখাবে দর্শক হিসেবে বরং নিজে এসব চিন্ময় খেলাধুলায়। অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে সমস্ত উপভোগের প্রাপ্তি পূরণ হয়। হরে কৃষ্ণ !
(মাসিক চৈতন্য সন্দেশ ফেব্রুয়ারী ২০১০ সালে প্রকাশিত)