কেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব?

প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২১ | ১১:১৯ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ২৯ আগস্ট ২০২১ | ৭:১৫ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 394 বার দেখা হয়েছে

কেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব?

শ্রীমৎ ভক্তিপুরুষোত্তম স্বামী

ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ। অনাদিরাদির্গোবিন্দঃ সর্বকারণকারণম্ ॥ পরম ব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণ সমস্ত কারণের কারণ, সব কিছুর আদি মূল । তাঁর আবির্ভাবের হেতু মানে এই জড় জগতে তাঁর আবির্ভাবের কারণ। তিনি তাঁর সচ্চিদানন্দ বিগ্রহরূপে নিত্য বর্তমান, তাঁর সেই চিন্ময়রূপকে জড় চক্ষুর দ্বারা এই জগতের জীব দর্শন করতে পারে না। অপ্রাকৃত বস্তু নহে প্রাকৃত ইন্দ্রিয় গোচর। তবুও সেই অপ্রাকৃত দিব্য শরীরধারী ভগবান লোকচক্ষুর গোচরীভূত হয়ে থাকেন। তাঁর জন্ম ও কর্মের কোন বাহ্যিক হেতু থাকতে পারে না। তাঁর আবির্ভাবের হেতু তিনি স্বয়ং।

নহাস্য জন্মনো হেতুঃ কর্মণো বা মহীপতে।
আত্মমায়াং বিনেশস্য পরস্য দ্রষ্টুরাত্মনঃ ॥

শুকদেব গোস্বামী বলেছেন, হে রাজন্ পরীক্ষিৎ! অবশ্যই এই পরম পুরুষ ভগবানের জন্ম ও কর্মের কোন হেতু নাই। সেই পরম নিয়ন্ত্রণকারী পরঃ অর্থাৎ এই জগতের ঊর্ধ্বে। পরমাত্মা রূপে সমস্ত কর্মের তিনি দ্রষ্টা, তাঁর আত্মমায়া অর্থাৎ বদ্ধ জীবের প্রতি তাঁর পরম করুণাই তার হেতু, তা ছাড়া আর কিছু নয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভগবদ্‌গীতা (৪/৮-৯) তাঁর অবতরণের হেতু সম্বন্ধে বলেছেন- “তিনি দুষ্কৃতদের সংহার করে এই ভূভার লাঘব করার জন্য এবং সাধুদেরকে রক্ষা করে ধর্ম সংস্থাপন করবার জন্য এই জগতে অবতীর্ণ হন।”
শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের কারণ সম্বন্ধে আমরা জানি যে, ক্ষীর সমুদ্রের তীরে বসুন্ধরা সহ ব্রহ্মা, শিবাদি দেবগণ ভগবান বিষ্ণুকে অসুরদের দ্বারা পৃথিবী আক্রান্ত হওয়ার কথা জানালে পৃথিবীর ভার হরণ করার জন্য স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ অবতীর্ণ হবেন, সেই নির্দেশ শ্রীবিষ্ণুর নিকট প্রাপ্ত হয়েছিলেন। এইভাবে শাস্ত্রে উল্ল্যেখ আছে, পৃথিবীর ভার হরণ করবার জন্য শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হয়েছিলেন। চৈঃ চঃ আদি ৪/৭ তে বলা হয়েছে-

পূর্ব্বে যেন পৃথিবীর ভার হরিবারে।
কৃষ্ণ অবতীর্ণ হৈলা শাস্ত্রেতে প্রচারে ॥

কিন্তু শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী এই ভূভার হরণকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবতীর্ণের বহিরঙ্গা বা আনুষঙ্গিক কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। “আনুষঙ্গ কর্ম্ম এই অসুর-মারণ।” অসুর নিধন শ্রীকৃষ্ণের নিজস্ব কার্য নয়। এই কর্ম শ্রীকৃষ্ণের শরীরের মধ্যে অবস্থান করে বিষ্ণুই করে থাকেন, তিনি সৃষ্টি ও পালন কর্তা; কিন্তু স্বয়ং ভগবান ৷
এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ম্ । তাই শ্রীকৃষ্ণ (চৈঃ চঃ আদি ৪/৮) এ বলেছেন,
কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ অবতীর্ণ হয়ে লীলাবিলাস কালে তিনি বহু অসুর নিধন করেছেন। তাঁর এই কর্মটি তাঁর মধ্যে স্থির হয়ে বিষ্ণু করেছেন। সেই জন্য এই কর্মটি তাঁর আনুষঙ্গিক কর্ম, মুখ্য কর্ম নয়।
শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর বলেছেন, ‘সঙ্গে অনু অনুগতস্য স্থিতস্য ইতি যাবৎ বিষ্ণোঃ কর্ম ইতি আনুষঙ্গিক কর্ম’। এই কারণকে বহিরঙ্গা কারণ বলা হয়। ভগবান যুগে যুগে অবতীর্ণ হয়ে অসুর সংহার করে পৃথিবীতে ধর্ম সংস্থাপন করেন । শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং প্রতি যুগে যুগে অবতীর্ণ হন না, তিনি প্রতি কল্পে একবার অবতীর্ণ হন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, ব্রহ্মার এক দিনে অর্থাৎ এক কল্পে একবার অবতীর্ণ হন। তাঁর এই অবতীর্ণের মূল কারণ বা মুখ্য কারণ কী? যে লাগি অবতার, কহি সে মূল কারণ। দেবকীর গর্ভস্থিত ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে প্রার্থনা করে ব্রহ্মাদি দেবতাগণ বলেছেন-
“হে ভগবান! আপনি সকাম কর্মের ফলে এই জড় জগতে জন্মগ্রহণকারী এক সাধারণ জীব নন। তাই এই জড় জগতে আপনার আবির্ভাব বা জন্ম আপনার হ্লাদিনী শক্তির দ্বারা সম্পাদিত লীলাবিলাস ছাড়া আর কিছুই নয়।”
শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর তাঁর টীকায় বলেছেন— “আমরা সমস্ত দেবগণ ক্ষীর সমুদ্র তীরে গিয়ে অসুর দ্বারা উৎপীড়িত পৃথিবীর ভার লাঘব করার জন্য প্রার্থনা করছিলাম।
আমরা যদি মনে করি আমাদের প্রার্থনা শুনে আপনি অবতীর্ণ হয়েছেন তবে তা আমাদের অভিমান সূচক হবে। আসলে আপনি স্বেচ্ছায় লীলাবিলাস (বিনোদন) করতে এসেছেন। হস্তিনাপুর ত্যাগ করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন দ্বারকায় ফিরে যাবেন ঠিক সেই সময় কুন্তীদেবী শ্রীকৃষ্ণকে প্রার্থনা করে বলেছেন, পরমার্থের পথে উন্নত পরমহংসের, মুনিদের (মহান দার্শনিক বা মনোধর্মীদের) জড় ও চেতনার পার্থক্য নিরূপণ করার মাধ্যমে যাঁদের অন্তর নির্মল হয়েছে, তাঁদের অন্তরে অপ্রাকৃত ভক্তিযোগ-বিজ্ঞান বিকশিত করার জন্য তুমি স্বয়ং অবতরণ কর। তাহলে আমার মতো স্ত্রীলোকেরা কিভাবে তোমাকে সম্যরূপে জানতে পারবে? (ভাগবত-১/৮/২০) এইভাবে কুন্তীদেবী এখানে ভগবানের অবতীর্ণের কারণ ‘ভক্তিযোগ বিধানাথম্‘ অপ্রাকৃত ভক্তিযোগ বিকশিত করার জন্য বলে বর্ণনা করছেন।
ব্রহ্মা শ্রীকৃষ্ণকে স্তব করে বলেছেন- “হে প্রভু! আপনি প্রপঞ্চাতীত ও সচ্চিদানন্দ হওয়া সত্ত্বেও শরণাগত জনের আনন্দ বর্ধন করার জন্য এই প্রপঞ্চে অবতীর্ণ হয়ে প্রাপঞ্চিক ব্যবহার অনুকরণ করে লীলাবিলাস করেন।” ব্রহ্মদেব ভগবানের অবতীর্ণের কারণ ভক্তগণকে আনন্দ প্রদান করা বলেছেন।
কংসের নির্দেশে শ্রীকৃষ্ণকে ব্রজ থেকে মথুরায় নিয়ে যাওয়ার জন্য যখন অক্রুর আসছিলেন তখন তিনি শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে চিন্তা করে ভাবছিলেন-তাঁর আত্মহৃদিস্থিত কার্য করবার জন্য অর্থাৎ তাঁর স্বরূপভূত বাসনা অনুযায়ী কার্য করার জন্য সম্প্রতি তিনি স্বেচ্ছায় নরলীলা প্রকট করেছেন।
(বিষ্ণু পুরাণ ৫/১৭/১২) শ্রীমদ্ভাগবতে (১/৮/৩০) কুন্তীদেবী তাঁর প্রার্থনায় বলেছেন-“হে বিশ্বাত্ম! তুমি প্রাকৃত কর্মরহিত হওয়া সত্ত্বেও কর্ম কর। তুমি প্রাকৃত জন্মরহিত এবং সকলের পরমাত্মা হওয়া সত্ত্বেও জন্মগ্রহণ কর। তুমি পশু, মানুষ, ঋষি এবং জলচর কুলে অবতরণ কর। স্পষ্টতই এ সমস্ত অত্যন্ত বিমোহিতকর।”
এই কথা বলে কুন্তীদেবী (ভাগবত ১/৮/৩২ ৩৫) চারটি শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবতীর্ণ হওয়ার বিভিন্ন কারণ প্রদর্শন করেছেন।
“কেউ কেউ বলেন পুণ্যবান রাজাদের মহিমান্বিত করার জন্য অজঃ জন্মগ্রহণ করেছে এবং কেউ কেউ বলেন তোমার অন্যতম প্রিয় ভক্ত যদুদের আনন্দ বিধানের জন্য তুমি জন্মরহিত হওয়া সত্ত্বেও যদু বংশে জন্মগ্রহণ করেছ। মলয় পর্বতের যশ বৃদ্ধির জন্য যেমন সেখানে চন্দন বৃক্ষের জন্ম হয়, তেমনই তুমি মহারাজ যদুর বংশে জন্মগ্রহণ করেছ।”
অন্য কেউ কেউ বলেন যে, বসুদেব এবং দেবকী তোমার কাছে প্রার্থনা করায় তুমি তাঁদের পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেছ। নিঃসন্দেহে তুমি প্রাকৃত জন্মরহিত, তথাপি তুমি তাঁদের মঙ্গল সাধনের জন্য এবং দেববিদ্বেষী অসুরদের সংহার করার জন্য জন্মগ্রহণ করেছ। অন্যেরা বলে যে সমুদ্রের মধ্যে নৌকার মতো পৃথিবী অতি ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে দারুণভাবে পীড়িত হরে তোমার পুত্র ব্রহ্মা তোমার কাছে প্রার্থনা জানায়, আর তাই তুমি সেই ভার হরণ করার জন্য অবতীর্ণ হয়েছ। আবার অনেকে বলেন, অবিদ্যাজনিত কাম ও কর্মের বন্ধনে আবব্ধ জড়-জাগতিক দুঃখ দুর্দশাগ্রস্ত জীবেরা যাতে ভক্তিযোগের সুযোগ নিয়ে জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে, সেই উদ্দেশ্যেই শ্রবণ, স্মরণ, অর্চনাদি ভক্তিযোগের পন্থাসমূহ পুনঃ প্রবর্তনের জন্য তুমি অবতরণ করেছিলে।

শ্রীকৃষ্ণের অবতীর্ণের মূল কারণ

পরিশেষে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ইহলোকে অবতীর্ণের মূল কারণ শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী বর্ণনা করেছেন।

“যে লাগি’ অবতার, কহি সেই মূল কারণ ॥”

তাঁর অবতীর্ণের দুইটি মূল কারণ হচ্ছে –

প্রেমরস-নির্যাস করিতে আস্বাদন।
রাগমার্গ-ভক্তি লোকে করিতে প্রচারণ ॥

ভগবানের এই দুই বাসনা পূরণের জন্য তিনি ভূলোকে অবতীর্ণ হয়েছেন। এই দুই বাসনার উৎপত্তির কারণ সম্বন্ধে তিনি বলছেন-

রসিক-শেখর কৃষ্ণ পরমকরুণ।
এই দুই হেতু হৈতে ইচ্ছার উদ্‌গম ॥

যেহেতু ভগবান রসিক-শেখর, তাই ভক্তের প্রেমরস-নির্যাস আস্বাদন করবার বাসনা এবং তিনি পরম করুণ, কারণ রাগমার্গ ভক্তি জগৎবাসীদের নিকট প্রচার করার বাসনা । হরে কৃষ্ণ


 

মাসিক চৈতন্য-সন্দেশ আগষ্ট-২০১৭ খ্রিষ্টাব্দ

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।