কেন ভগবানের বহু ভুজ?

প্রকাশ: ১০ জুন ২০২৩ | ১২:৪৯ অপরাহ্ণ আপডেট: ১০ জুন ২০২৩ | ১২:৪৯ অপরাহ্ণ

এই পোস্টটি 188 বার দেখা হয়েছে

কেন ভগবানের বহু ভুজ?

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ষড়ভুজ রূপ
বৈদিক শাস্ত্রে উল্লেখিত বহু ভুজ বিশিষ্ট দৈব রূপ সমূহের ব্যাখ্যা
সত্যরাজ দাস


যখন আমি হরেকৃষ্ণ আন্দোলনে যুক্ত হই তখন শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থ সমূহ আমাকে মন্ত্র মুগ্ধ করে: ভগবানের রয়েছে অসীম অস্বাভাবিক প্রকৃতি, তার রয়েছে অসংখ্যা রূপ এবং এসকল রূপের অধিকাংশতে রয়েছে বহু ভুজ বিশিষ্ট রূপ যা আমি জেনে অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছি। ভারতের পাণ্ডিত্যপূর্ণ শাস্ত্ৰেসমূহে প্রকৃতপক্ষে বহুভুজ বিশিষ্ট দেবতা ও জীবে পূর্ণ, বহু আশ্চর্যকর গ্রহলোকের কথা বর্ণিত হয়েছে। বিশেষত চতুর্ভূজ বিষ্ণু ও তাঁর শক্তি অষ্টভুজ লক্ষ্মী, রুদ্র মূর্তি, দশভুজা কালী, সহস্র বাহু অসীম সৌন্দর্য অর্ধ সিংহ ও অর্ধ নররূপ বিশিষ্ট ভগবান নৃসিংহদেব অন্যতম । এই সকল ভগবানের অবতার ও তাদের সেবকগণ একটি বহুমাত্রিক অপ্রাকৃত জগতে বসবাস করছেন যা বৈদিক শাস্ত্রানুসারে আমাদের সকলের প্রকৃত আলয় হিসেবে পরিচিত এটিই হল ভগবদ্ধাম । ভগবানের বহুভুজ সম্পর্কে জেনে আমি খুব বিস্মিত হয়েছিলাম। কেননা ভগবান বা তাঁর শক্তির বহু প্রকারের বাহুর প্রয়োজন কেন? কেন দ্বিভুজ যথেষ্ট নয়? এ প্রসঙ্গে আমার একটি পুরাতন ইংরেজি সংঙ্গীতের কথা মনে পড়ল, “বিশ্ব জগৎ আছে আমার আপন হাতের মুঠোয়।” সুতরাং ভগবান সমগ্র জগৎকে তার হাতে ধারণ করতে পারেন। হয়তোবা ঐতিহ্য অনুসারে অধিক হস্ত দ্বারা তিনি অধিক সংখ্যক জগৎকে ধারণ করতে পারেন। সর্বোপরি কেন ভগবানকে মানুষের অঙ্গের সমতুল্য হতে হবে?
বহু ভুজ প্রদর্শনের মাধ্যমে তিনি মানুষের সীমাবদ্ধতা আর ভগবানের অসীম শক্তিমত্তার পরিচয় প্রদর্শন করেছেন। গ্রীক দার্শনিক জেনোফেইন বলেছিলেন, ধর্মীয় দেবতারা হলো আমাদের দ্বারা প্রাপ্তি রূপ। তিনি বলেছিলেন, আমরা সর্বদাই ভগবানকে আমাদের রূপ দিয়ে বিবেচনা করি কেননা আমরা মানুষ। আমরা কি কখনো বৃক্ষ কিংবা অন্যান্য প্রাণী হতে পারি যাতে আমরা ভগবানের অন্যান্য প্রকৃতি সম্পর্কে আরো গভীরভাবে জ্ঞান অর্জন করতে পারি? যদি আমরা বৃক্ষ কিংবা অন্যান্য প্রাণী হতাম তবে হয়তো আমরা ভগবানকে বৃক্ষরূপে কিংবা প্রাণী রূপে আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হতাম।
এই ধারণার সাথে বৈদিক ধারণার অমিল নেই। আমরা বৈদিক শাস্ত্রে দেখি এ জগতে পরমেশ্বর ভগবান সৃষ্টির নানা প্রাণীর রূপ পরিগ্রহ করে আবির্ভূত হয়েছেন যেমন মৎস, কূর্ম, বরাহ এমনকি নরসিংহ রূপেও। ভগবান সম্পর্কিত বৈদিক ধারণা শুধুমাত্র মানবরূপ প্রদর্শন করে না, তাই জেনোফেইনের দর্শন অনুসারে আমরা বলতে পারি ভগবান সম্পর্কিত বৈদিক দর্শন কোন মানুষের আবিষ্কৃত নয়। কেননা যদি কোন মানুষ এই দর্শন প্রদান করত তবে কখনই ভগবানকে নিম্নতর প্রাণীকুলের মত দর্শন করার কল্পনাও আমাদের মনে আসত না। এভাবে আমাদের দর্শনকে আরো একটু বিস্তৃত করলে আমরা পাবো ভগবানের বহু ভুজ রূপ হলো আমাদের সীমাবদ্ধ জ্ঞানের অতীত বিষয়। বৈদিক শাস্ত্রানুসারে, ভগবান মানুষের দুই হাতের মত সীমাবদ্ধ নয় ।

কেন এত হস্ত?

সাধারণত ভগবান ও তার শক্তিসমূহ তাদের হস্তে কিছু বিশেষ বস্তু ধারণ করেন যার দ্বারা সেই ভগবান বা তাঁর শক্তির বিভিন্ন গুণাবলীর প্রকাশ হয়। মাঝে মাঝে, তাদের হস্ত শূন্য থাকে তথাপিও তাদের হস্তের আঙ্গুল এমনভাবে থাকে যার দ্বারা তাদের ভাব ও চরিত্র ফুটে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ ঐতিহ্যগত ভরত নাট্যম নৃত্যে হস্তের অঙ্গভঙ্গি যা নাট্যশাস্ত্র থেকে এসেছে তার প্রতিটি ভঙ্গির বিশেষ অর্থ রয়েছে। যদি নৃত্যকারের আঙ্গুলের দিক ভূমিমুখী হয় তবে তার অর্থ হলো সেই দেব বর প্রদান করছেন। কিন্তু যদি আঙ্গুল ঊর্ধ্বমুখী হয় তবে তার অর্থ হলো তিনি সুরক্ষা প্রদান করবেন। এসকল অঙ্গভঙ্গীকে বলা হয় মুদ্রা যা দ্বারা সেই বিশেষ দেবতার স্বতন্ত্র শক্তি প্রকাশিত হয় এবং তাকে অন্যদের চাইতে আলাদা রাখে।
বিষ্ণু ধর্মোত্তর পুরাণ মতে সকল দেবতাদের মধ্যে বিষ্ণু হলেন শ্রেষ্ঠ এবং বিষ্ণুর চতুর্ভুজ দ্বারা জগতের চতুর্দিকের আধিপত্য নির্দেশ করে। এর দ্বারা তার নামের অর্থ পাওয়া যায় যিনি সর্বব্যাপ্ত।
একই পুরাণে আরো ব্যাখ্যা করা হয়েছে বিষ্ণুর চতুর্বাহু মানব জীবনের চারটি লক্ষ্য (পুরুষার্থ) নির্দেশ করে ।
১. ধর্ম (কর্তব্য ও গুণ)
২. অর্থ (সম্পদ ও সফলতা লাভের জন্য সাধনা)
৩. কাম (ইন্দ্ৰিয়তৃপ্তি)
৪. মোক্ষ (মুক্তি)
তবে এদের মধ্যে প্রধানতম উদ্দেশ্য হল ভগবানের প্রতি প্রীতিপূর্ণ ভালোবাসা অর্পণপূর্বক ভগবানের ধামে প্রত্যাবর্তন। এটাই মানব জাতির প্রকৃত উদ্দেশ্য ।
ভগবান বিষ্ণু চার হস্তে চারটি দিব্য বস্তু ধারণ করেন যা দ্বারা ভগবান সম্পর্কে আরো অধিক জ্ঞান লাভ করা যায়। শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম। আমার স্মরণে আছে যখন আমি প্রাচ্য দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম তখন আমি জেনেছিলাম “শঙ্খ’ দ্বারা সৃজনশীলতা এবং বিজয়, ‘চক্র’ দ্বারা মনো শক্তি (এটি একটি অস্ত্র যা দ্বারা ভগবান দৈত্য সংহার করেন এবং সন্দেহ নিরসন করেন), ‘গদার’ মাধ্যমে ভীতির সঞ্চার হয় এবং এটি দ্বারা শক্তি মত্তা বুঝায় এবং ‘পদ্ম’ দ্বারা মুক্তি এবং জড় জগতের ঊর্ধ্বে অবস্থানের সামর্থ্য বুঝায় । পারমার্থিক জগৎ এবং জড় জগতে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অসংখ্য বিষ্ণুর প্রকাশ রয়েছে। চৈতন্য মহাপ্রভু সনাতন গোস্বামীকে শিক্ষা প্রদানের সময় সিদ্ধান্ত সংহিতা অনুসারে বিষ্ণুর চতুর্বাহুর চারটি প্রতীকের ভেদ অনুসারে চব্বিশটি রূপের বর্ণনা দেন। এছাড়াও মহাপ্রভু হয়শীর্ষ পঞ্চরাত্র অনুসারে বিষ্ণুর আরো ১৬টি রূপের বর্ণনা করেছেন (চৈ. মধ্য ২০/২৩৭) শ্লোকের তাৎপর্যে সেই ষোলজন হচ্ছেন যথাক্রমে ১. বাসুদের, ২. সঙ্কর্ষণ, ৩. প্রদ্যুম্ন, ৪. অনিরুদ্ধ, ৫.কেশব, ৬. নারায়ণ, ৭. মাধব, ৮. গোবিন্দ, ৯. বিষ্ণু, ১০. মধুসূদন, ১১. ত্রিবিক্রম, ১২. বামন, ১৩. শ্রীধর, ১৪. হৃষীকেশ, ১৫. পদ্মনাভ এবং ১৬. দামোদর ।

ষড়ভুজ রূপ

ভগবানের বহুভুজরূপ সমূহের মধ্যে আমি বিশেষভাবে ষড়ভুজরূপ তথা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ছয় হস্তবিশিষ্ট রূপের প্রতি আকর্ষিত ছিলাম। অর্জুনকে দর্শন করানো ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ এবং দশভুজ উগ্র নৃসিংহ রূপের কথা জেনে আমি অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হই। মহাপ্রভুর মোহনীয় ষড়ভুজের প্রতি আমার গভীর ভালোবাসা জন্মে যা এখনো রয়েছে। আমি ষড়ভুজ মূর্তির নানা ছবি সংগ্রহ করেছি যেগুলো এই প্রবন্ধে প্রকাশিত হচ্ছে।
আমি এই সম্পর্কিত শ্রীল প্রভুপাদের বর্ণনা পড়েছি: “শ্রীগৌরসুন্দরের ছয় বহুবিশিষ্ট ষড়ভুজরূপ তাঁর তিনটি অবতারের প্রতীক। দুই হাতে রামচন্দ্রের ধনুর্বাণ, দুই হাতে শ্রীকৃষ্ণের মুরলী এবং দুই হাতে শ্রীচৈতন্য মহাপভুর দণ্ড ও কমণ্ডলু। তবে নিত্যানন্দ প্রভুকে তিনি তখন যে ষড়ভুজরূপ দেখিয়েছিলেন, সেইরূপে তাঁর চার হাতে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম এবং অপর দুই হাতে ধনুক ও মুরলী । (চৈ.চ.আদি ১৭/১২ তাৎপর্য)
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সকলরূপ একই সাথে দর্শন। এই এই বিষয়টি অনেক পছন্দ করলাম এবং জানলাম শ্রীল প্রভুপাদও এই রূপকে বিশেষ বলে বর্ণনা করেছেন। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র তাঁর ভক্তদের প্রতি এতই কৃপালু যে, মানুষই হোক বা অন্য যে কেউ হোক তাঁর ভক্তের অল্প সেবাতেই তিনি সন্তুষ্ট হন। এটিই শ্রীরামচন্দ্রের আরাধনা করার একটি বিশেষ সুবিধা। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আরাধনাতেও এই সুবিধাটি রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীরামচন্দ্র ক্ষত্রিয়রূপে কখনও কখনও অসুরদের সংহার করে তাঁদের কৃপা প্রদর্শন করেছেন, কিন্তু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু অসুরদের পর্যন্ত অনায়াসে প্রেম দান করেছেন। ভগবানের সমস্ত অবতারেরা বিশেষ করে শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁদের সম্মুখে উপস্থিত প্রায় সমস্ত জীবদের উদ্ধার করেছেন। তাই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁদের সম্মুখে উপস্থিত প্রায় সমস্ত জীবদের উদ্ধার করেছেন। তাই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ষড়ভুজ মূর্তিতে প্রকাশিত হয়েছেন, যা হচ্ছে শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মিলিত রূপ-দুহাত শ্রীরামচন্দ্রের, দুহাত শ্রীকৃষ্ণচন্দ্রের এবং দুহাত শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর। মানব জীবনের পরম উদ্দেশ্য এই ষড়ভুজ রূপের আরাধনার ফলে সাধিত হয়। (শ্রীমদ্ভাগবতম ৫/১৯/৮ তাৎপর্য)

চৈতন্য সন্দেশ অ্যাপ ডাউনলোড করুন :https://play.google.com/store/apps/details?id=com.differentcoder.csbtg


আমি দেখলাম ষড়ভুজ রূপের সকল প্রাচীন চিত্রকলাসমূহ উড়িষ্যা রাজ্যে পাওয়া যায়, বিশেষত উড়িষ্যার জগন্নাথ মন্দিরের দেওয়ালে এবং গঙ্গামাতা গোস্বামীনীর মঠে ।
পুরীর প্রধান মন্দিরের দক্ষিণ-পূর্বাংশে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ষড়ভুজের একটি বিগ্রহ রয়েছে। এই রূপের দর্শন লাভ করেছিলেন রাজা প্রতাপ রুদ্র ও তার সভা পণ্ডিত সার্বভৌম ভট্টাচার্য, তারা দুইজন পুরীতে বসবাস করতেন। তাই রাজা সেই রূপের প্রকাশ চিত্রকলার মাধ্যমে মন্দিরের গম্বুজের বাইরের অংশে, নাট মন্দিরের ছাদে এবং মন্দিরের দক্ষিণ প্রবেশদ্বারের সন্নিকটবর্তী একটি কক্ষে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত অনুসারে মহাপ্রভু এই রূপে তার অন্তরঙ্গ পার্ষদ নিত্যানন্দ প্রভুকে দর্শন দিয়েছিলেন। বিভিন্ন শতকে বিভিন্ন শিল্পীরা তাদের তুলিতে এই রূপ এঁকেছেন, কিন্তু আমার সবচেয়ে প্রিয় ষড়ভুজটি হল ইস্‌কন  ভক্তদের আঁকা ষড়ভুজরূপ যা ব্যাক টু গডহেড ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে।

ইতিহাস উন্মোচন ও তার লুকায়িত অর্থ

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর যথাযথ জীবনী অনুসারে তিনি এইরূপ তিনবার প্রদর্শন করেছেন নিম্নোক্ত ক্রমে:
১। মায়াপুরে শ্রীবাস অঙ্গনে নিত্যানন্দ প্রভুকে ষড়ভুজ রূপে দর্শন দান । এই লীলাটি সংঘটিত হয়েছিল ব্যাসপূজা (ব্যাসদেবের পূজা) উদ্‌যাপনের সময়, যেটি ছিল মহাপ্রভু এবং নিত্যানন্দ প্রভুর সর্বপ্রথম মিলনের দ্বিতীয় দিন ।
(আরো জানতে পড়ুন চৈতন্য ভাগবত মধ্য ৫/৫২, শ্রীচৈতন্য চন্দ্রোদয় নাটিকা-২, শ্লোক-৭৫ এবং শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত আদি ১৭/১২)
শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত ও শ্রীচৈতন্য চন্দ্রোদয় মতে নিত্যানন্দ প্রভু ভিন্নতর ষড়ভুজ রূপ দর্শন করেছিলেন যেখানে মহাপ্রভুর ছয় হাতে ছিল শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম, তীর ধনুক ও বাঁশি।
২. পুরীতে সার্বভৌম ভট্টাচার্যকে তার গৃহে ষড়ভুজ দর্শন করান ।
(আরো জানতে পড়ুন চৈতন্য ভাগবত অন্ত ৩/১০০-১০৫, শ্রীচৈচ আদি ১০/১৩০ শ্রীল প্রভুপাদের তাৎপর্য এবং শ্রীল প্রভুপাদ বিরচিত ‘শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা’ গ্রন্থের ২৬ অধ্যায়।)
৩. সার্বভৌম ভট্টাচার্যকে উদ্ধারের ২ বছর পর যখন তিনি দক্ষিণ ভারত ভ্রমণ শেষে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন তখন মহারাজ প্রতাপ রুদ্রকে ষড়ভুজ দর্শন দেন।
(আরো জানতে পড়ুন মুরারীগুপ্ত রচিত শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য চরিত মহাকাব্য ৪/১৬/১৪-২০ ও লোচন দাস ঠাকুর রচিত চৈতন্যমঙ্গল শেষ কাণ্ড, সঙ্গীত ১২, শ্লোক ১১৩-১১৫)
লোচনদাস ঠাকুর বিরচিত চৈতন্য মঙ্গল গ্রন্থে আমরা নিম্নোক্ত পদ্যসমূহ পাই যার মাধ্যমে আমরা মহাপ্রভুর ষড়ভুজ রূপ সম্পর্কিত আরো গভীর দর্শন লাভ করতে পারি।
চৈতন্য মহাপ্রভুর সন্ন্যাস গ্রহণের পর তিনি তার সন্ন্যাস দণ্ডের প্রতি প্রার্থনা জানিয়ে তিনি বলেছিলেন এই দণ্ড তাঁর প্রতিটি প্রকাশের অবিচ্ছেদ্য অংশ ঠিক যেমন তীর ধনুক ও বাঁশি ।
আমি সে সকল ছাড়ি করিনু সন্ন্যাস
তুমি না ছাড়িলে মোরে জন্মে জন্মে বংশে রাম অবতারে তুমি ধেনুক হইয়া
রহিলে আমার হাতে দুষ্টেরও লাগিয়া
কৃষ্ণ অবতারে বংশী হইয়া মোর করে মোহিত করিলে সব অখিল সংসারে
এবে দণ্ড হইয়া মোর আইলা করেতে কলিযুগে পাষণ্ড দলন হেতু রূপে
এই প্রার্থনা থেকে আমরা ভগবানের সম্পর্কে জানতে পারি এবং হাতে থাকা বিভিন্ন প্রতীক সমূহের মধ্যে সম্পর্ক জানতে পারি বিশেষত, ভগবানের রাম, কৃষ্ণ ও চৈতন্যলীলার মাধ্যমে । শ্রীল প্রভুপাদের গুরুদেব শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর (চৈতন্য ভাগবত মধ্য ৫/১০৫)
শ্লোকের ভাষ্যে লিখেছেন, এই ষড়ভুজ রূপের আরেকটি অন্তর্নিহিত অর্থ প্রদান করেছেন: এই অপ্রাকৃত প্রকাশ দর্শন দানের মাধ্যমে ভগবান চৈতন্য তার অচিন্ত্য ভেদাভেদ তত্ত্ব (ভগবান ও তার বিবিধ রূপ এবং শক্তির মধ্যকার ভেদ ও অভেদ) উপস্থাপন করেছেন। প্রকাশ, অবতার, শক্তি এবং ভক্ত এগুলো স্বয়ং রূপ পরমেশ্বর ভগবান থেকে আলাদা নয়। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর মধ্যে এর সবকিছুই যুগপৎ অবস্থান করে। গৌর লীলায় ভগবান অচিন্ত্য ভেদাভেদ প্রকাশ করার জন্য শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুকে তার ষড়ভুজ রূপ দর্শন দিয়েছিলেন।
প্রচলিত বৈষ্ণব দর্শন অনুসারে অচিন্ত্য ভেদাভেদ তত্ত্ব মূলত ভগবান এবং তার শক্তির মধ্যে সম্বন্ধ ব্যাখ্যা করে। অর্থাৎ তিনি এক আবার তিনি তার শক্তি থেকে ভিন্ন। শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর এক্ষেত্রে ভগবানের বিভিন্ন অবতারসমূহের কথা উল্লেখ করেছেন। তাই আমরা বলতে পারি ভগবান তার সমস্ত অবতার এবং প্রকাশসমূহের সাথে এক আবার ভিন্নতর রূপে অবস্থান করে। তার মতে ষড়ভুজ মূর্তি হলো সত্যের প্রকাশ ।
রাধাগোবিন্দ দাস যিনি ‘ষড়ভুজ’ নামক একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন তার মতে তিন জোড়া হস্ত মাধুর্য পুরুষোত্তম, লীলা পুরুষোত্তম এবং প্রেম পুরুষোত্তম রূপ প্রদর্শন করছে। পুরুষোত্তম অর্থ সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। ভগবান রামচন্দ্র ন্যায় নীতি, বিধি নিষেধ (মর্যাদা) পালনে সর্বশ্রেষ্ঠ, কৃষ্ণ হলেন সেই সর্বশ্রেষ্ঠ ভগবান যিনি তাঁর ভক্তদের আনন্দ বিধানের জন্য বিভিন্ন চমৎকার লীলা বিলাস প্রকাশ করেছেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু অকাতরে অপ্রাকৃত প্রেম বিতরণ করেছেন তাই ভগবানের সর্বশ্রেষ্ঠ তিন রূপের সম্মিলন হল এই ষড়ভুজ মূর্তি যা সত্যি অনন্য। ইস্কনের একজন নেতৃস্থানীয় প্রচারক শ্রীমৎ ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বামী বলেন, “ষড়ভুজ মূর্তি অর্থ ধর্ম, আনন্দ এবং প্রেম । ভগবান রামচন্দ্র এই জগতে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছেন, কৃষ্ণ তাঁর দিব্য লীলা বিলাসের মাধ্যমে আনন্দ প্রদান করেছেন এবং মহাপ্রভু আমাদের সকলের জন্য দিব্য প্রেম নিয়ে এসেছেন।

হাত ও হৃদয়

উপসংহার হলো ভগবানের অসীম হাত থাকতে পারে কিংবা একটি হাত থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে। বৈদিক শাস্ত্রে ভগবানের অসংখ্য দিব্য রূপের এবং বহু ভুজের বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু সেই সকল শাস্ত্র অনুসারে ভগবানের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হস্ত নয় বরং তার হৃদয় ও ভালোবাসা। যদিও ভগবানের অসংখ্য উদ্দেশ্য ও অর্থ অনুসারে অসংখ্য হাত রয়েছে তথাপিও তার হৃদয় একটি আমাদের প্রতি তার ভালোবাসা হলো একমুখী ।
আমার মতে শ্রীল প্রভুপাদ প্রাঞ্জলভাবে সবকিছু সন্নিবেশ করেছেন বিশেষত তিনি বলেছেন “ভগবানের হাতের দুটি উদ্দেশ্য রয়েছে বিশেষত যেটি চতুর্ভূজ বিষ্ণুর মধ্যে দর্শনীয়: তাঁর দুই হাতে অসুর দমনের জন্য অন্য দুই হাত ভক্তদের সুরক্ষা প্রদানের জন্য।’
“সুতরাং যখন কৃষ্ণ আসেন তাঁর দুটি উদ্দেশ্য তাকে: পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্ । ভক্তদের সুরক্ষা প্রদান ও অসুরদের বিনাশ । তাই কৃষ্ণ যখন এজগতে উপস্থিত ছিলেন তখন তিনি এই দুটি উদ্দেশ্য সাধন করেছিলেন। তোমরা হয়ত নারায়ণ বা বিষ্ণুর ছবি দেখেছ তার দুই হাতে রয়েছে শঙ্খ ও পদ্ম অন্য দুই হাতে রয়েছে চক্র ও গদা। ভগবানের চক্র ও গদা বিনাশায় চ দুষ্কৃতাং অর্থাৎ অসুরদের নিধনের জন্য এবং তার শঙ্খ ও পদ্ম ভক্তদের বর ও কৃপা প্রদানের জন্য ।
(শ্রীল প্রভুপাদ প্রবচন মেলবোর্ন ৬ এপ্রিল ১৯৭২) কবি কর্ণপুর রচিত ষোড়শ শতকের রচনা শ্রীচৈতন্য চন্দ্রোদয় (নাটিকা ২ পদ্য ৮২) এ ষড়ভুজ মূর্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে: “কেউ বলে থাকেন সেই ষড়ভুজ দিয়ে তিনি পৃথিবীর ছয়টি শত্রুকে (কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য) বিনাশ করেন। কিন্তু আমি বলি যে, আপনি ষড়ভুজ দিয়ে ভক্তিমূলক সেবা, ভগবৎ প্রেম ও জীবনের চারটি লক্ষ্য প্রদান করেন।”
প্রকৃতপক্ষে, ষড়ভুজে ভগবান রামচন্দ্রের দুই হস্তের তীর ধনুক অসুরদের হৃদয়ে ভয়ের সৃষ্টি করে যখন কৃষ্ণের দুই হস্তের বাঁশি ভক্তির পথে উৎসাহিত করে এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু আমাদের সর্বোচ্চ প্রেম যা আমরা কৃষ্ণভাবনার পথে লাভ করতে পারি তা প্রদান করেন। মহাপ্রভুর দুই হস্ত ভক্তদের জড় জগতের সীমা অতিক্রম করে সর্বদাই পারমার্থিক দিব্য সংস্পর্শে জড়িয়ে রাখে।
লেখক পরিচিতি : সত্যরাজ দাস (স্টিভেন জে. রোজেন) একজন আমেরিকান লেখক। শ্রীল প্রভুপাদের অন্যতম একজন শিষ্য এবং শ্রীমৎ ভক্তিতীর্থ স্বামী মহারাজের অন্তরঙ্গ জন। বৈদিক শাস্ত্রের বিবিধ বিষয়ের ওপর ২০টিরও বেশী গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি জার্নাল অব বৈষ্ণব স্টাডিজ এর প্রধান সম্পাদক ও আন্তর্জাতিক ব্যাক টু গডহেড এর সহ সম্পাদক। তাঁর অন্যতম বিখ্যাত একটি গ্রন্থ হলো, শ্রীমৎ ভক্তিতীর্থ স্বামী মহারাজের জীবনী সম্বলিত ব্ল্যাক লোটাস : দ্যা স্পিরিচুয়াল জার্নি অব এন আর্বান মিস্টিক 

 

ব্যাক টু গডহেড, জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৮ হতে প্রকাশিত

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।