কেন এই রূপ?

প্রকাশ: ১৮ জুন ২০২১ | ১১:২৩ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ১৮ জুন ২০২১ | ১১:৪১ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 257 বার দেখা হয়েছে

কেন এই রূপ?

ভগবান বা শ্রী জগন্নাথের কেন এই রূপ? এই প্রশ্নটি প্রায় অনেকে করে থাকেন। আবার জগন্নাথদেবের এই রূপ নিয়ে অনেক ভ্রান্ত ধারণাও রয়েছে। আর তাই এসব ভ্রান্ত ধারণার নিরসনকল্পে এখানে জগন্নাথের এই রূপ কেন বিষয়ক একটি বিশ্লেষণাত্মক প্রতিবেদন তুলে ধরা হল। আজ থেকে হাজার হাজার বছর পূর্বে ভগবান শ্রীবিষ্ণুর একজন মহান ভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন তাঁর প্রভুকে মুখোমুখি, স্বচক্ষে দর্শন করার আকাঙ্খা করেন। তিনি সংবাদ পান যে ভগবান শ্রীবিষ্ণু নীলমাধব বিগ্রহ-রূপে ইন্দ্রদ্যুম্নের দ্বারা রাজকীয়ভাবে পূজিত হতে চান। মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন যখন ঐ স্থানে উপনীত হলেন, তিনি সেই বিগ্রহের দর্শন পেলেন না। তখন একটি দৈববাণী হল যে ‘রাজা নীলগিরির শীর্ষদেশে একটি মন্দির নির্মাণ করবেন এবং শ্রীজগন্নাথ সেখানে দারুবিগ্রহরূপে প্রকটিত হবেন’। দেব আজ্ঞা অনুসারে মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন যথাস্থানে সুরম্য, সুদৃশ্য একটি মন্দির নির্মাণ করলেন এবং তার চতুর্দিকে রামকৃষ্ণপুর নামে একটি নগর প্রতিষ্ঠা করলেন। রাজা অভিলাষ করলেন যে ব্রহ্মাজী ঐ মন্দিরের উদ্বোধন করবেন, সেজন্য তিনি ব্রহ্মাকে আমন্ত্রণ জানাতে ব্রহ্মলোকে গেলেন। কিন্তু ব্রহ্মলোকে সময় প্রবাহ ভিন্ন; সেজন্য তিনি সেখানে থেকে যখন প্রত্যাগমন করলেন, ইতিমধ্যে পৃথিবীতে তখন কয়েক শতাব্দী অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে, আর প্রবল বালুকা ঝড়ে মন্দির বালুকারাশির নীচে অন্তর্হিত হয়ে গেছে। তাঁর প্রস্থানের পর ৮ জন রাজা তাঁর রাজ্য শাসন করেছেন, এবং দ্বিতীয় রাজা, গলমাধবের রাজত্বকালে ঐ মন্দির আবার পুনরায় উন্মুক্ত করা হয়েছে। যখন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন গিয়ে জানালেন যে, তিনি ঐ মন্দিরটি নির্মাণ করেছেন, তখন কেউই তাঁর কথা বিশ্বাস করল না। ঐ মন্দিরের অনতিদূরে ভূষণ্ডী নামক একটি কাক বাস করতেন। ভূষণ্ডী রাজার বক্তব্যে সমর্থন জানালে রাজা গলমাধব ইন্দ্রদ্যুম্নের দাবী মেনে নিলেন। মন্দির উদ্বোধনের আয়োজন শুরু হল। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন তখন ব্রহ্মাকে অনুরোধ করলেন মন্দির উদ্বোধন করতে ও শ্রীক্ষেত্র নামে পরিচিত মন্দিরের পারিপার্শ্বিক স্থান পবিত্রীকৃত করতে। কিন্তু ব্রহ্মা বললেন, “এই স্থান পরমেশ্বর ভগবানের অন্তরঙ্গা শক্তি হতে প্রকাশিত হয়েছে; ভগবান এখানে নিত্যকাল বিরাজমান, এবং যখন তিনি অভিলাষ করেন, তখনই মাত্র তিনি প্রকটিত হন। ভগবানকে এখানে প্রতিষ্ঠা করা আমার সামর্থ্যের অতীত”।
একথা শ্রবণ করে ইন্দ্রদ্যুম্ন অধীর হয়ে পড়লেন। ইতিকর্তব্যের জন্য ভগবৎ নির্দেশের প্রতীক্ষা করতে লাগলেন; কিন্তু প্রতীক্ষা করতে করতে একসময় তাঁর ধৈর্য হতাশায় পর্যবসিত হল; তাঁর জীবন নিরর্থক বিবেচনা করে তিনি অনশনে প্রাণত্যাগের সংকল্প করলেন। তখন শ্রীজগন্নাথ তাঁর নিকট স্বপ্নে আবির্ভূত হয়ে বললেন, “প্রিয় রাজন, উৎকন্ঠা ত্যাগ কর; আগামী কাল আমি দারুব্রহ্মরূপে বাইকিমুহান নামক স্থানে সমুদ্রতীরে ভেসে আসব।” পরদিন আনন্দোল্লাসমুখর কীর্তন সহযোগে মহোদধি সমুদ্রের তট হতে দারুব্রহ্মকে জলে বিধৌত করা হল এবং একটি স্বর্ণরথে করে প্রাসাদে মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্নের নিকট আনয়ন করা হল। তিনি ঐ দারু (কাষ্ঠ) হতে মূর্তি নির্মাণ করার জন্য অনেক ভাস্করকে ডাকলেন, কিন্তু তাঁদের কেউই ঐ দারু খোদাই করতে সমর্থ হল না; তাদের ছেনি দারু-গোত্র স্পর্শ মাত্র টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেল। তারপর একজন শিল্পী নিজেকে অনন্ত মহারাণা রূপে পরিচয় দিয়ে রাজার নিকট বিগ্রহ খোদাইয়ের অনুমতি চাইলেন। অনেকের মতে এই মূর্তিশিল্পী, অনন্ত মহারাণা ছিলেন, ভগবান স্বয়ং; অন্য অনেকে বলেন যে দেবলোকের স্থপতি বিশ্বকর্মাই ভগবানের সেবা করার জন্য এসেছিলেন তিনি শর্ত দিলেন যে বিগ্রহ নির্মাণের জন্য তাঁকে একুশ দিন সময় দিতে হবে, এজন্য তাঁকে কক্ষে একাকী রেখে কক্ষদ্বার বন্ধ রাখতে হবে – একুশ দিনের মধ্যে ঐ ঘরে কেউই প্রবেশ করতে পারবে না। মূর্তি নির্মাণ শুরু হল; প্রতিদিন রাজা মন্দির কক্ষের দরজার সামনে দিয়ে ব্যাকুল প্রত্যাশা নিয়ে পদচারণা করতেন। কিন্তু চতুর্দশ দিনে তাঁর আশা উৎকন্ঠায় পর্যবসিত হল, কেননা তিনি ঐ শিল্পীর যন্ত্রপাতির শব্দ আর শুনতে পেলেন না। তাঁর মন্ত্রীরা তাঁকে বার বার নিষেধ করলেও ব্যাকুলচিত্ত রাজা দ্বারের তালা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকলেন। কিন্তু সেখানে কোথাও ঐ শিল্পী ভাস্করকে দেখা গেল না! রাজা দেখলেন, দারুব্রহ্ম হতে তিন বিগ্রহ প্রকটিত হয়েছেন- জগন্নাথ, সুভদ্রা, এবং বলদেব। আরো কাছাকাছি গিয়ে রাজা লক্ষ্য করলেন যে বিগ্রহসমূহের হস্ত-পদ অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছে।
“ওঁ, হায়! আমি এ কি করলাম!” রাজা তীব্র অনুশোচনা করতে লাগলেন, “আমি কেন এত অধৈর্য হয়ে পড়লাম! এখনো বিগ্রহ স -সমূহের নির্মাণকার্য অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে, মূর্তি শিল্পীও অন্তর্হিত হয়েছেন। আমি একজন মহা অপরাধী। এইভাবে অনুতাপে দগ্ধ হয়ে রাজা আবারও অনশনে প্রাণত্যাগের সঙ্কল্প করলেন। রাত্রির প্রথমার্ধ্ব অতিবাহিত হলে শ্রীজগন্নাথ স্বপ্নে রাজার কাছে আবির্ভূত হয়ে বললেন, “আমি এই জড়জগতে আমার ধাম-সহ চব্বিশ-মূর্তিতে অবতীর্ণ হই। আমার কোন জড় হস্ত-পদ নেই, কিন্তু আমার অপ্রাকৃত ইন্দ্রদ্বয় দ্বারা আমার সেবার্থে আমার ভক্ত-প্রদত্ত সমস্ত দ্রব্য গ্রহণ করে থাকি এবং জগতের মঙ্গলের জন্য আমি এক স্থান হতে অন্য স্থানে গমন করে থাকি। তুমি তোমার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছ, কিন্তু সেটি এই জগতে আমার এই বিশেষ জগন্নাথ রূপ প্রকটিত করার লীলার একটি অংশ মাত্র, যার দ্বারা বেদের এই উক্তির সত্যতা প্রতিপালিত হয় যে, ‘তাঁর পদ না থাকলেও তিনি গমন করেন, এবং ‘হাত ছাড়াও তিনি আহার করতে পারেন।’ কিন্তু আমি এই রূপে প্রকটিত হলেও, যাঁরা আমার ভক্ত, তাঁরা আমাকে মুরলীধর শ্যামসুন্দর রূপেই দর্শন করবে। অবশ্য যদি তোমার আমাকে ঐশ্বর্য আড়ম্বর সহকারে আরাধনা করার অভিলাষ হয়ে থাকে, তাহলে কখনো কখনো তুমি আমাকে স্বর্ণ ও রৌপ্য নির্মিত হস্ত পদাদি দ্বারা শোভিত করতে পারো। অবশ্য তুমি নিশ্চিত জানবে যে, আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সকল রত্নাভরণের শোভা স্বরূপ।”
স্বপ্নে শ্রীজগন্নাথের এই বাণী শ্রবণ করে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট হলেন এবং তাঁর নিকট এইভাবে প্রার্থনা করতে লাগলেন, “প্রতিদিন আপনার মন্দিরের দ্বার যেন মাত্র তিন ঘন্টা বন্ধ থাকে, যাতে ব্রহ্মাণ্ডের সকল অধিবাসীগণ আপনার দর্শন লাভ করতে পারে। তাছাড়া, যেন এমনভাবে ক্রমাগত সারাদিন আপনার ভোজন চলতে থাকে যাতে আপনার পদ্মহস্তে জল না শুকায়।” শ্রী জগন্নাথ উত্তর দিলেন, “তথাস্তু।” আর তখন থেকেই শ্রী জগন্নাথ দেবের এই রূপ প্রকটিত হয়েছিল ॥ হরে কৃষ্ণ ॥

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।