এই পোস্টটি 242 বার দেখা হয়েছে
কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ
আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের (ইস্কন) প্রতিষ্ঠাতা আচার্য
কর্তৃক ১৯৭৫ সালের ১২ জুলাই, ফিলাডেলফিয়ায় রথযাত্রা উপলক্ষে প্রদত প্রবচনের বঙ্গানুবাদ।
ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহোদয়াগণ, প্রথমত আমি এই মহান নগরী ফিলাডেলফিয়ার সকল অধিবাসীদের ধন্যবাদ জানাতে চাই এই আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য। আপনারা এতটাই সদয় ও আগ্রহান্বিত যে, আপনাদের কাছে আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। বিশেষত আমেরিকার যুবক-যুবতীদের কাছে আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ, যারা পাশ্চাত্য দেশগুলিতে এই কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে আমাকে অত্যন্ত সাহায্য করছেন। এই কৃষ্ণভাবনামৃত পাশ্চাত্য দেশগুলিতে প্রচার করার. জন্য আমি আমার গুরুমহারাজ দ্বারা নির্দেশিত ছিলাম। তাই আমি ১৯৬৫ সালে প্রথম নিউইয়র্কে আসি। তারপর ১৯৬৬ সালে এই সংঘ নিউইয়র্কে নিয়মিতভাবে নিবন্ধিকৃত হয় এবং ১৯৬৭ সন থেকে এই আন্দোলন ক্রমশ আমেরিকা, ইউরোপ, কানাডা, দক্ষিণ প্রশাস্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, অস্ট্রেলিয়া তথা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
তাই আমি কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন সম্বন্ধে অল্প কিছু জানাব। কৃষ্ণ, এই কথাটির অর্থ হচ্ছে ‘সর্বাকর্ষক’। কেবলমাত্র মানুষ নয়, কৃষ্ণ প্রতিটি জীবের কাছেই আকর্ষক, এমনকি পশু, পাখী, মৌমাছি, বৃক্ষ, ফুল, ফল, জলের কাছেও। সেটিই হচ্ছে বৃন্দাবনের চিত্র। আর এটি হচ্ছে জড় জগৎ। চিন্ময় জগতের কোনো অভিজ্ঞতাই আমাদের নেই। কিন্তু চিন্ময় ও জড় বিষয়ে আমরা এরকম ঝলক ধারণা লাভ করতে পারি। কেবলমাত্র জীবিত মানুষ ও মৃত দেহের পার্থক্যটি হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করুন। মৃত দেহের অর্থ হলো, যে জীবনী, শক্তি দেহের অভ্যন্তরে ছিল তা চলে গেছে, তখন সেটি মৃত বস্তু, অপ্রয়োজনীয়। আর যতক্ষণ পর্যন্ত জীবনী শক্তি সেখানে থাকে, দেহটি তখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তাহলে আমরা দেহের অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পারছি যে, মৃত বস্তু ও জীবনী শক্তি রয়েছে। তেমনই দুটি জগৎ রয়েছে…জড় জগৎ ও চিন্ময় জগৎ। আমরা এই জড় জগতের নই। যে কোনোভাবেই হোক আমরা ও জড় দেহের সংস্পর্শে এসেছি। যদিও আমরা নিত্য জীবনী শক্তি কিন্তু এই জড় দেহের সংস্পর্শে আসার জন্য আমাদের জন্ম, মৃত্যু, জরা ও ব্যাধি এই চারটি ক্লেশকর অবস্থা গ্রহণ করতে হচ্ছে। এই চারটি অবস্থার মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হচ্ছে। এই জড় জগতে আমরা এক ধরনের দেহ লাভ করছি এবং তা একটি অবস্থার মধ্যে গিয়ে শেষ হচ্ছে যে কোনো জড় জিনিসের মতোই। যেমন আপনার পোশাকটিকেই গ্রহণ করুন। আপনি কোনো একটি নির্দিষ্ট ধরনের বস্ত্র পরিধান করেছেন কিন্তু যখন এটি ছিড়ে যাবে, আর ব্যবহারযোগ্য থাকবে না, তখন আপনি এটি ফেলে দেবেন, আপনি আরেকটি বস্তু পরিধান করবেন। তাই এই জড় দেহটি হচ্ছে জীবনী শক্তি বা আত্মার বস্ত্র। কিন্তু যেহেতু আমরা এই জড় জগতের প্রতি আসক্ত, আমরা এই জড় জগতকে ভোগ করতে চাই, তাই আমরা বিভিন্ন ধরনের দেহ লাভ করি। ভগবদ্গীতায় একে যন্ত্ররূপে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই দেহটি হচ্ছে একটি যন্ত্র।
ভগবদ্গীতায় (১৮/৬১) শ্লোকে বলা হয়েছে-
ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং
হৃদ্দেশেহর্জুন তিষ্ঠতি ।
ভ্রাময়ন্ সর্বভূতানি
যন্ত্রারূঢ়ানি মায়য়া ৷৷
“হে অর্জুন! পরমেশ্বর ভগবান সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থান করছেন এবং সমস্ত জীবকে দেহরূপ যন্ত্রে আরোহণ করিয়ে মায়ার দ্বারা ভ্রমণ করান।
“আমরা জীব, আমরা কামনা করি। মানুষ অভিপ্রায় করে, ভগবান বিন্যস্ত করেন।” ভগবান অত্যন্ত দয়ালু। আপনি যা আকাঙ্ক্ষা করেন, তিনি তা পূর্ণ করবেন। যদিও তিনি বলছেন যে, “এই ধরনের জড় আকাঙ্ক্ষা কখনই তোমাকে সন্তুষ্ট করবে না” তবুও আমরা আকাঙ্ক্ষা করি। সুতরাং ভগবান কৃষ্ণ আমাদের বিভিন্ন আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের দেহ প্রদান করেন। একে বলে জাগতিক বদ্ধ জীবন। আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী দেহের পরিবর্তনকে বলা হয় বিবর্তন পন্থা। বিবর্তনের দ্বারা অন্য বহু লক্ষ লক্ষ দেহের মাধ্যমে এই মনুষ্য রূপে এসেছি। জলজা নব লক্ষাণি, স্থাবরা লক্ষ বিংশতি। নয় লক্ষ প্রকারের জলজ জীবদেহে আমরা অতিবাহিত করি। তেমনই কুড়ি লক্ষ প্রকারের বৃক্ষ, লতাদি। এইভাবে, প্রাকৃতিকভাবে প্রকৃতি আমাদের মনুষ্য রূপে নিয়ে আসে কেবলমাত্র আমাদের চেতনার জাগ্রতকরণ বা উন্নতি সাধনের জন্য। প্রকৃতপক্ষে আমাদের সুযোগ প্রদান করেছে, ‘এখন তুমি কি করতে চাও? এখন তুমি উন্নত চেতনা লাভ করেছ। এখন তুমি আবার কি বিবর্তন পন্থায় ফিরে যেতে চাও, অথবা উচ্চতর লোকে যেতে চাও, কিংবা ভগবান কৃষ্ণের কাছে যেতে চাও, নাকি এখানেই থেকে যেতে চাও’? এই সমস্ত পছন্দগুলি রয়েছে।
ভগবদ্গীতায় (৯/২৫) বলা হয়েছে-
যান্তি দেব্রতা দেবান্ পিতৃণ্ যান্তি পিতৃব্রতাঃ।
ভূতানি যান্তি ভূতেজ্যা যান্তি মদ্যাজিনোহপিমাম্ ॥
এখন আপনি বেছে নিন। আপনি যদি উচ্চতর লোকে যেতে চান, যেতে পারেন। আপনি যদি এই মধ্যলোকে থেকে যেতে চান, আপনি থেকে যেতে পারেন। আর আপনি যদি নিম্নতর লোকে যেতে চান, আপনি সেটিও করতে পারেন এবং আপনি যদি ভগবান কৃষ্ণের কাছে যেতে চান, সেটিও আপনি করতে পারেন। এই সব আপনার পছন্দের ওপর নির্ভর করছে। তাহলে জড় জগতের সঙ্গে উচ্চতর লোক বা নিম্নতর লোকের পার্থক্যটি কোথায় আর চিন্ময় জগৎটিই বা কি? চিন্ময় জগতের অর্থ হচ্ছে সেখানে কোনো জড় ভোগ নেই, সবকিছুই চিন্ময়, আমি আগে বলেছি। বৃক্ষ, ফুল, ফল, জল, প্রাণী–সবকিছুই চিন্ময়। তাই সেখানে কোনো ধ্বংস নেই, সেটি নিত্য। তাই আপনি যদি সেই চিন্ময় জগতে যেতে চান তাহলে এখন এই মনুষ্য রূপধারী জীবনে আপনি সুযোগটি গ্রহণ করতে পারেন। আর আপনি যদি এই জড় জগতে থেকে যেতে চান, আপনি তা করতে পারেন। তাই আমাদের আন্দোলনটি হচ্ছে, “কেন এই জন্ম, মৃত্যু, জরা, ব্যাধির পৌণঃপুনিকতা সম্পন্ন এই বদ্ধ জীবনের সমাপ্তি হবে না?” এটিই বুদ্ধিমত্তা। “কেন আমরা বারবার দেহ পরিবর্তন করে এই জড় দেহে থেকে যাব? আমাদের মূল চিন্ময় দেহটি গ্রহণ করা যাক।” সেটিই চাই, সেটিই বুদ্ধিমত্তা। তাই বেদান্ত দর্শনে বর্ণনা করা হয়েছে, এই মনুষ্য জীবনের অর্থ হচ্ছে অথাতো ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা এখন এই জীবনটি পরম সত্য বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য।সেটিই প্রয়োজন। সেটিই মনুষ্য বুদ্ধিমত্তা। আমরা যদি পশুর মতো আমাদের জীবনকে নষ্ট করি তবে সেটি বুদ্ধিমত্তা নয়। তারাও খাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে, মৈথুন করছে ও আত্মরক্ষা করছে। আমরাও তা করছি। এই চারটি নীতি মানুষ ও পশু উভয়ের মধ্যেই আছে। মানুষের মধ্যে যে বিশেষ সুবিধাটি রয়েছে তা হলো যদি সে পছন্দ করে তবে সে বারংবার জন্ম ও মৃত্যুকে রোধ করে তার স্বগৃহ ভগবদ্ধামে ফিরে যেতে পারে । কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন মানুষকে এই বিজ্ঞানেই শিক্ষিত করতে চাইছে যে কি করে ভগবদ্ধামে, নিজ গৃহে ফিরে যাওয়া যায়। এটি কোনো তথাকথিত ধর্মীয় আন্দোলন নয়। অবশ্যই ভগবানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোনোকিছুকে আপনি ধর্মীয় আন্দোলনরূপে গ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু এটি অত্যন্ত বিজ্ঞান সম্মত আন্দোলন। বড় বড় বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের এই আন্দোলন হৃদয়ঙ্গম করা উচিত। দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকদের বুঝবার জন্য আমাদের বহু গ্রন্থ রয়েছে। আপনি যদি এই আন্দোলনের মূল্যটিকে বিজ্ঞান ও দর্শনের মাধ্যমে জানতে চান আপনাকে যোগান দেওয়ার জন্য আমাদের যথেষ্ট উপাদান রয়েছে। অন্যথায় এটি সরল, অত্যন্ত সরল। কেবলমাত্র এই মন্ত্রটি জপ করুন –
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ।।
তখন সবকিছুই আপনার কাছে প্রকাশিত হবে। চেতোদর্পণ মার্জনম্। এই হরেকৃষ্ণ মন্ত্র জপ করার অর্থ হলো আপনার হৃদয়ের অন্তঃস্থল মার্জন করা। কেননা আমাদের হৃদয় বা মন বা চেতনা অসংখ্য নোংরা বস্তু দ্বারা আচ্ছন্ন রয়েছে। তাই আমরা যদি এই হরেকৃষ্ণ মন্ত্র জপ করি তাহলে এই সমস্ত নোংরা বস্তু পরিষ্কার হয়ে যাবে। তখন আমি দেখতে সমর্থ হব যে, “আমার অবস্থানটি কি, আমার জীবনের উদ্দেশ্য কি এবং আমাকে কি করতে হবে।” এটিই হচ্ছে মানুষের বিবেচ্য। কুকুর, বিড়াল তারা এসব করতে পারে না। কিন্তু একজন মানুষ, তা অত্যন্ত সুন্দরভাবে করতে পারে।
তাই এই বিষয়ে আপনারা দেখতে পারবেন যে, এই সমস্ত তরুণেরা কেবল আপনাদের দেশ থেকেই নয়, অন্যান্য দেশ থেকেও, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউরোপ, এশিয়া-প্রত্যেক জায়গাতেই যখনই তারা এই দর্শনকে হৃদয়ঙ্গম করছে, তখনই তারা এই আন্দোলনে যোগদান করছে। আর এটা কঠিন কিছু নয়। হরেকৃষ্ণ মন্ত্র প্রচার করার জন্য আমরা কোনো অর্থ দাবী করছি না। আমরা সর্বত্রই কীর্তন করছি। এই রথযাত্রাতেও আপনারা তা দেখছেন। এখন আমাদের একমাত্র কাজই হলো কীর্তন করা। আর এই হাজার হাজার লোক কেবলমাত্র হরেকৃষ্ণ মন্ত্র কীর্তনকে অনুসরণ করছে। তাহলে আপনারা বুঝতে পারছেন যে, এই হরেকৃষ্ণ মন্ত্রের শক্তি কতটা।
ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহোদয়াগণ, আমাদের অনুসরণ করার জন্য কাউকে টাকা পয়সা দিচ্ছি না। আমরা কেবলমাত্র হরেকৃষ্ণ কীর্তন করছি। এটি অত্যন্ত শক্তিসম্পন্ন। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের এক মহান আচার্য নরোত্তম দাস ঠাকুর গেয়েছেন, ‘গোলকের প্রেমধন হরিনাম সংকীর্তন’। এই হরেকৃষ্ণ আন্দোলন বা হরেকৃষ্ণ কীর্তন, এটি জড় জাগতিক কোনো কিছু নয়। তাই আপনি কখনও হরেকৃষ্ণ কীর্তন করতে ক্লান্ত হবেন না। আপনি বাস্তবিকভাবে তা করে দেখুন। আপনি চব্বিশ ঘণ্টা কীর্তন আপনি ক্লান্ত অনুভব করবেন না। তাই একে বলা হয়েছে ‘গোলকের প্রেমধন’। এই কীর্তন শব্দতরঙ্গ চিন্ময় জগৎ থেকে আসছে। ঠিক আপনারা যে রকম রেডিও বা টেলিভিশনে দূরবর্তী স্থান থেকে জাগতিক ধ্বনি তরঙ্গ গ্রহণ করেন তেমনি আরেকটি যন্ত্র রয়েছে যা চিন্ময় জগতের তরঙ্গ গ্রহণ করতে পারে। আর সেই তরঙ্গ ‘হরেকৃষ্ণ মন্ত্র’ ।
গোলোকের প্রেমধন ‘হরিনাম সংকীর্তন’
রতি না জন্মিল কেনে তায়।
অর্থাৎ “ওহ্ আমি এতই অভাগা যে, আমি এই হরেকৃষ্ণ মন্ত্র কীর্তন করার জন্য কোনো আসক্তি লাভ করছি না।” সংসার-বিষানলে দিবানিশি হিয়া জ্বলে। সংসার অর্থাৎ এই জড় জগত অত্যন্ত অস্বচ্ছন্দ স্থান। প্রত্যেকেই সর্বদা উদ্বিগ্নতায় পূর্ণ। আপনি যতই ধনী বা যতই ক্ষমতা সম্পন্ন হোন না কেন, উদ্বিগ্নতা থাকবেই। আপনারা বুঝতে পারবেন, আপনাদের রাষ্ট্রপতি নিক্সন, যখন সকল জনসাধারণ চাইল তিনি পদত্যাগ করুক তখন তার কতই না উদ্বিগ্নতা। তাই এই জড় জগতের অর্থই হল আপনি কোন্ অবস্থায় আছেন সেটা কোনো ব্যাপার নয়। এটি উদ্বিগ্নতায় পূর্ণ। একে বলা হয় প্রচণ্ড আগুন, সর্বদা হৃদয়কে পোড়াচ্ছে। তাই আপনি যদি এই উদ্বিগ্নতাপূর্ণ অস্বচ্ছন্দ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চান তাহলে আপনাকে অবশ্যই এই হরেকৃষ্ণ মন্ত্র গ্রহণ করতে হবে। এটি আমাদের অনুরোধ। আপনি এটা চেষ্টা করে দেখতে পারেন এবং আপনি এর বাস্তব ফল দেখতে পারবেন। এতে আপনার কোনোরকম মূল্য দিতে হচ্ছে না, তাই এতে কোনো ক্ষতি নেই।
বৈষ্ণব সম্প্রদায়েরর এক মহান আচার্য নরোত্তম দাস ঠাকুর, তিনি গান গেয়েছেন, ‘গোলোকের প্রেমধন হরিনাম সংকীর্তন’। এই হরেকৃষ্ণ আন্দোলন যা হরেকৃষ্ণ কীর্তন, এটি জড় জাগতিক কোনো কিছু নয়। তাই আপনি কখনও হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করে ক্লান্ত হবেন না।
তাই আমাদের একমাত্র অনুরোধ হচ্ছে, করজোড়ে আপনাদের কাছে আবেদন করছি, আমরা কেবল অনুরোধ করছি, আপনারা সংকীর্তনে যুক্ত হন এটি আমাদের পন্থা। এখন, আপনারা দেখেছেন, আমাদের শোভাযাত্রা আসছে, অনেকক্ষণ প্রায় তিন ঘণ্টা। কোনো হিংস্রতা নেই এবং আপনাদের দেশের পুলিশ হ বিভাগ, তারাও অত্যন্ত প্রশংসা করেছে, কেননা তাদের অভিজ্ঞতা হলো যে, যখন কোনো শোভাযাত্রা হবে, তখন সেখানে হিংস্রতা থাকবে। তারা বলে “শান্তি ভঙ্গকারী জনতা” কিন্তু এই লোকেরা শান্তি ভঙ্গকারী নয়। তাই এই কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনকে আপনাদের অনেক তরুণেরাই গ্রহণ করেছে। তাই আমরা অনুরোধ করছি-‘আপনারা হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করুন’ তাহলে আপনারা অনেক বেশি সুখ অনুভব করবেন। কোনো উদ্বিগ্নতা থাকবে না এবং তারপর আপনি আপনার কাজ করতে পারবেন। আপনি কি করছেন সেটা কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু এই হরেকৃষ্ণ মন্ত্র কীর্তন জাগতিক উদ্বিগ্নতা থেকে মুক্ত করে আপনাকে আরো, আরো সুখী করে তুলবে। আমরা যদি এই পন্থাটি নিয়মিত করে যাই, তাহলে পারমার্থিক জীবন সম্বন্ধে সবকিছু পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে এবং অতি সহজেই আমাদের প্রকৃত আলয় ভগবদ্ধামে ফিরে যেতে সমর্থ হব আমরা।
এই উৎসব সম্বন্ধে আমি কিছু বর্ণনা করব। এখানে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, জগন্নাথ, বলদেব ও সুভদ্রা। তাঁরা হচ্ছেন কৃষ্ণ ও তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলরাম এবং তাঁর ভগিনী = সুভদ্রা। ভারতে, দিল্লির নব্বই মাইল উত্তরে একটি জায়গা রয়েছে। কুরুক্ষেত্র নামক স্থানটিকে পবিত্র তীর্থক্ষেত্র রূপে বিবেচনা করা হয়। সূর্য গ্রহণ ও চন্দ্র গ্রহণে মানুষ এখনও সেখানে সমবেত হয়। পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে একবার সূর্যগ্রহণ কালে ভারতের সমস্ত অঞ্চলের মানুষেরা কুরুক্ষেত্রে এসেছিল। দ্বারকার রাজা কৃষ্ণ সেসময়, তিনি ও তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ও ভগিনীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। কৃষ্ণ তাঁর শিশুকালে বৃন্দাবনে মহারাজ নন্দ ও মাতা যশোদার পালিত পুত্র রূপে বড় হয়েছিলেন। তারপর তিনি যখন বড় হলেন.. আপনারা ‘কৃষ্ণ’ গ্রন্থে এই ইতিহাস পাবেন। তো ঘটনা হলো যে, বৃন্দাবনে কৃষ্ণ একজন অতি প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। তাই তিনি যখন বৃন্দাবন ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, তখন সেখানকার মানুষেরা, তারা অত্যন্ত বিষণ্ণ হয়েছিলেন। সুতরাং কৃষ্ণ যখন তাঁর ভ্রাতা ও ভগিনিকে সঙ্গে নিয়ে দ্বারকা থেকে কুরুক্ষেত্রে এলেন, বৃন্দাবন বাসীরা তখন খবর পেলেন যে, কৃষ্ণ সেখানে আসছেন। বৃন্দাবনও প্রায় একই দূরত্বে। কুরুক্ষেত্রের দূরত্বটা বেশি। যাই হোক, তাদের ভালোবাসা বশতঃ তাঁরা কৃষ্ণকে দেখতে এলেন। পরম প্রেমাস্পদ শ্রীমতী রাধারাণী, তিনি কৃষ্ণকে অনুরোধ করতে লাগলেন, “তুমি সেই একই কৃষ্ণ আমি সেই একই রাধারাণী। কিন্তু স্থানটি এক নয়। তুমি রাজকীয় ঐশ্বর্য নিয়ে এখানে কুরুক্ষেত্রে এসেছ আর আমরা গ্রাম থেকে এসেছি। তাই দয়া করে তুমি আবার বৃন্দাবনে ফিরে চল।” এই ছিল রাধারাণীর অনুরোধ। আর এটি অত্যন্ত উৎফুল্ল জনক অনুভূতি। যাঁরা উত্তম ভক্ত, তারা সেটি উপভোগ করতে পারে।
আমরা এই ঘটনাটি পাশ্চাত্য দেশগুলির বহু জায়গায় বাৎসরিকভাবে উদযাপন করি। এই মুহূর্তে আমরা লন্ডন, সানফ্রান্সিসকো, শিকাগো, ফিলাডেলফিয়া এবং মেলবোর্নে এই উৎসব উদযাপন করছি। এটি একটি অত্যন্ত অনুভব সম্পন্ন উৎসব। আপনারা এখানে এসেছেন। তাই আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। আমাদের দর্শনটি হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করুন। আপনারা সকলেই শিক্ষিত যুবক যুবতী। আমাদের বহু গ্রন্থ রয়েছে। সেই সব গ্রন্থ পড়ার চেষ্টা করুন এবং হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করুন। আর এটি অত্যন্ত ঐকান্তিকভাবে গ্রহণ করুন, তাহলে আপনারা সুখী হবেন। সবাইকে ধন্যবাদ।