এই পোস্টটি 115 বার দেখা হয়েছে
চৈতন্য চরণ দাস
ইচ্ছা না থাকলে কখনোই কোনো উপায় হয় না। চিন্ময় স্তরে ইতিবাচক চিন্তনের শক্তিকে আবদ্ধ করার জন্য আমাদের জীবনে কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন, যা অনেকেই করতে চায় না। “আমি এ রকমই”, “এটাই আমার স্বভাব”, “আমি তা পরিবর্তন করতে পারি না”, “আমি এভাবেই গড়ে উঠেছি”- তারা তাদের সীমাবদ্ধতা এবং ত্রুটিসমূহের পেছনে যুক্তি দেখানোর জন্য এই বিবৃতিসমূহ ব্যবহার করে। এ কি সত্য যে, আমরা যেমন আছি, সবসময়ই তেমনই থাকব? অথবা আমাদের পরিবর্তন করার শক্তি কি আমাদের রয়েছে? আমাদের আচরণ কি পরিবর্তনীয়? “কেউই আরেকজনকে পরিবর্তন বা চালিত করতে পারে না। আমাদের প্রত্যেকেই পরিবর্তনের একটি দ্বার পাহারা দিই, যা কেবল ভেতর থেকে খোলা যেতে পারে, হয় যুক্তির মাধ্যমে নয় আবেগকে আহ্বানের মাধ্যমে।” মরিলিন ফারগুসন একটি তত্ত্ব প্রস্তাব করেন, “যে বাহ্যিক বিষয়সমূহের দ্বারা আমাদের আচরণ নির্ধারিত হয়, তাকে নির্ধারণমূলক তত্ত্ব বলে।” ৩টি প্রধান নির্ধারণমূলক তত্ত্ব রয়েছে। যেমন:
১। জীনগত নির্ধারণ : “আমার পিতামহ আমাকে এটি দিয়েছেন।” এই তত্ত্ব বলে যে, জীনের মাধ্যমে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ আমাদের আচরণ নির্ধারণ করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, “আমি কম রাগী, কারণ আমার জীনসমূহ আমাকে সেভাবে তৈরি করেছে।”
২। মানসিক নির্ধারণ : “আমার পিতামাতা আমার জন্য এটি করেছেন।” এই তত্ত্ব প্রস্তাব দেয় যে, আমাদের গড়ে ওঠা আমাদের আচরণ নির্ধারণ করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, “আমার একটি হীনমন্যতা রয়েছে, কারণ আমার পিতামাতা ক্রমাগত আমার সাথে আমার বড় ভাইয়ের তুলনা করতেন, যে সর্বদা আমার চেয়ে বেশি নাম্বার পেত।”
৩। পরিবেশগত নির্ধারণ: “আমার পরিবেশ আমার চারপাশের সমাজ আমার প্রতি এটি করছে।” এই তত্ত্ব দাবি করে যে, আমরা আমাদের পরিবেশের অধীন। দৃষ্টান্তস্বরূপ, “আমার একটি বিরক্তিকর স্বভাব রয়েছে, কারণ আমার চারপাশের লোকেরা বিরক্তিকর।”
বৈদিক অন্তর্দৃষ্টি এ সকল নির্ধারণমূলক তত্ত্বসমূহকে অতিক্রম করে। আমাদের জীন, গড়ে ওঠা এবং পরিবেশ আমাদের আচরণ ও প্রকৃতির উপর প্রভাব ফেলে। কিন্তু আমাদের তাদের দাস বা শিকারে পরিণত হলে চলবে না। এ সকল কিছুর ঊর্ধ্বে রয়েছে স্বাধীন ইচ্ছা যা স্থায়ীভাবে আমাদের সকলকে প্রদান করা হয়েছে। আমরা কেবল নির্বোধ যন্ত্র নই যা বাহ্যিক প্রণোদনার প্রতি পূর্বনির্ধারিত উপায়ে প্রতিক্রিয়া জানায়। প্রণোদনা এবং আমাদের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি নিহিত রয়েছে – ইচ্ছাশক্তি। এ ইচ্ছাশক্তি দুর্বল হলেও তা চর্চার দ্বারা এবং ভগবানের কৃপার দ্বারা শক্তিশালী হতে পারে। সেজন্য আমাদের জীন, গড়ে ওঠা এবং পরিবেশের সাথে সাথে আরো দুটি বিষয় আমাদের আচরণকে নির্ধারণ করে, তা হলো ইচ্ছা শক্তি এবং ভগবানের কৃপা।
- ইচ্ছাশক্তি : “আমি যা ছিলাম তার চেয়ে ভালো হওয়ার বাসনা করতে এবং নির্বাচন করতে পারি।” সে যদিও নেতিবাচকভাবে চিন্তা করতে অভ্যস্ত হতে পারে কিন্তু আমরা
ইতিবাচকভাবেও নির্বাচন করতে পছন্দ করতে পারি। দৃষ্টান্তস্বরূপ, আমরা যখন ব্যর্থতার স্বীকার হই, তখন “আমি এটি করতে পারি না; তাই আমি তা এড়িয়ে চলি।” এরূপ ভাবার পরিবর্তে আমরা চিন্তা করতে পারি, “আমি অনেক কিছু শিখেছি। এরূপ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পরিপক্ক হবার দ্বারা আমি সাফল্যের নিকটবর্তী হবো।” - ভগবানের কৃপা : ভগবান তাদেরই কৃপা করেন, যারা তাঁর সহায়তা স্বীকার করার দ্বারা নিজেদের সহায়তা করে। আমরা যখন সঠিক উপায়ে সঠিক লক্ষ্যের জন্য আন্তরিকভাবে প্রয়াস করি, আমরা আমাদের চেয়ে বৃহত্তর কোনো শক্তিকে তথা ভগবানের কৃপা আকর্ষণ করতে পারি, যা আমাদের সাধারণ সক্ষমতার অতীতে যেতে শক্তিদান করে। ভগবান প্রয়াসবিহীনভাবে পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারেন, যা আমরা অসম্ভব বলে মনে করি। এ পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে প্রথম তিনটি – জীন, মানসিক এবং পরিবেশ – সবকিছুই আমাদের পূর্বকৃত কর্মের দ্বারা নির্ধারিত হয়। আমরা কত আন্তরিকতা এবং দৃঢ়তার সাথে আমাদের স্বাধীন ইচ্ছার অনুশীলন করি, সে অনুসারে ভগবান আমাদের ওপর তাঁর আশীর্বাদ তথা কৃপা প্রদান করেন। সেজন্য আমাদের আচরণের চূড়ান্ত দায়িত্ব আমাদেরই। পৌরুষের সাথে এ দায়িত্ব স্বীকার করার দ্বারা আমাদের স্বাধীন ইচ্ছাকে উপযুক্তভাবে ব্যবহার করে আমরা সকলেই আমাদের জীবনে এক উজ্জ্বল নব পর্যায়ের দ্বার উন্মোচন করতে পারি, বিশেষত আমরা যখন ভগবানের কৃপার ওপর নির্ভর করি । “দৈব ইচ্ছার সাথে মানব ইচ্ছার শৃঙ্খলা বিধান মানুষের পক্ষে যা অসম্ভব, ভগবানের পক্ষে তা সম্ভব।” – বাইবেল (লুক ১৮:২৭) ইচ্ছাশক্তি থাকলে আমরা বিস্ময় ঘটাতে পারি; ইচ্ছাশক্তি ব্যতীত আমরা পঙ্গু হয়ে যাই। কী ইচ্ছাশক্তিকে শক্তিশালী করে? এবং কী একে দুর্বল করে? এ প্রসঙ্গে উপনিষদে খুব সুন্দর উপমা দেয়া হয়েছে – এখানে দেহকে একটি রথের সাথে তুলনা করা হয়েছে, পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা এবং ত্বক) হচ্ছে পাঁচটি অশ্ব, মন হচ্ছে বলগা, বুদ্ধি হচ্ছে সারথি এবং আত্মা হচ্ছে যাত্রী । যাত্রী তখনই তার প্রত্যাশিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে, যখন সারথি বলগাগুলোকে ব্যবহার করে অশ্বগুলোকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালিত করতে শক্তিশালী হবে। তদ্রুপ, আমরা কেবল তখনই আমাদের লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হব, যখন আমাদের বুদ্ধিমত্তা আমাদের মনকে ব্যবহার করে ইন্দ্রিয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে ও নির্দেশনা দান করতে যথেষ্ট শক্তিশালী হবে। এ উপমায় যে বুদ্ধিমত্তা রয়েছে তা IQ দ্বারা পরিমাপকৃত বুদ্ধিমত্তা থেকে ভিন্ন। দেহ-রথ উপমায় বিচারবোধ সারথির দৃষ্টিভঙ্গির স্থিরতা ও পরিচ্ছন্নতাকে নির্দেশ করে এবং প্রত্যয় তার দৈহিক শক্তিমত্তা এবং অশ্ব চালনার দক্ষতাকে বুঝায়। সেজন্য ইচ্ছাশক্তিকে বৃদ্ধি করতে হলে আমাদের বিচারবোধ এবং প্রত্যয়কেও বাড়ানো প্রয়োজন। চলমান…