এই পোস্টটি 238 বার দেখা হয়েছে
রাজেশ্বর গৌরাঙ্গ দাস
চলে এল নতুন বছর ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ। বিশ্বজুড়ে নানা আয়োজনের মধ্যে থাকে নতুন বর্ষ। নতুন বর্ষকে ঘিরে মানুষ আশা বেঁধেছে নতুন নতুন স্বপ্ন নিয়ে আর সে সাথে সবাই পুরানো দুঃসহ স্মৃতিগুলোকে ভুলে যেতে চাইবে সেটিই স্বাভাবিক। সবাই চাইবে এই নতুন বছরটি শুভ হোক, অনেক সৌভাগ্য নিয়ে আসুক প্রত্যেকের জীবনে আর তাই তো প্রতিটি দেশে রয়েছে বিশেষ বিশেষ কিছু প্রথাগত সংস্কৃতি যেগুলো পালনের মাধ্যমে তারা আশায় বুক বাধে নতুন বছরটি যেন অত্যন্ত সৌভাগ্যের হয়। এজন্যেই সবার মুখে মুখে শোনা যায় হ্যাপি নিউ ইয়ার।
বিচিত্র উদ্যাপন এরকম কিছু কিছু দেশ রয়েছে যারা নতুন বছরকে লাকী করার জন্য কিছু বিচিত্র নিয়ম পালন করে থাকে। এই যেমন ডেনমার্কে একটি ঐতিহ্য রয়েছে কেউ তার বন্ধুর গৃহের দরজায় স্নেহভরে থালা, কাপ ইত্যাদি ভাঙ্গে যাতে করে কোন অশুভ আত্মা যদি থাকে তা চলে যেতে পারে। থাইল্যান্ডে থাইরা নতুন বছর উদযাপনের সময় প্রিয়জনের দিকে জল ছুড়ে মারে যাতে করে প্রতিকী তার সব মন্দভাগ্য ধুইয়ে চলে যায় এবং অফুরন্ত সৌভাগ্য নিয়ে আসে। দক্ষিণ আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে এরকম প্রথা রয়েছে যে তারা জানালা দিয়ে ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েবসের মত বড় বড় আসবাবপত্র ছুড়ে ফেলে। তাদের ধারণা এরকম অব্যবহৃত কিছু জিনিস জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেললে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কাছে সিগন্যাল পাঠায় যাতে করে অতীতের দুর্দশাময় স্মৃতি দূরে টেলে দিয়ে সুন্দর কোন ভবিষ্যতের যেন আগমন ঘটে । স্পেনের অনেক অঞ্চলে পুরানো বছরের শেষ ১২ সেকেণ্ড তাদের নতুন বছরের ভাগ্য নির্ধারণ করে বলে মনে করে, আর কেউ যদি ১২ সেকেণ্ডে ১২টি আঙ্গুর খেতে পারে তবে নতুন বছরের ১২টি মাস তার জন্য সৌভাগ্যের হবে। ব্রাজিলের মানুষ যদিও রঙ্গিন পোশাক পছন্দ করে। কিন্তু অনেকেই নতুন বছরকে বরণ করে সাদা পোশাক পরে যাতে করে নতুন বছর সৌভাগ্যের হয়। জাপানে মধ্য রাতে সবাই নতুন বছরে অধিক সুখী জীবন লাভের জন্য ১০৮ বার ঘন্টা বাজায়। সাউথ কোরিয়াতে, সবজি ও আরো কিছু বিশেষ আইটেম দিয়ে সুপ তৈরি করে এবং সেটি খেলে নতুন বছরটি নিয়ে আসে বলে বিশ্বাস করে। পিলিফাইনে ১২টি গোকৃতির ফল খুঁজে বের করলে আগামী বছর শুভ হবে বলে ধারণা করা হয়। এভাবে আয়ারল্যান্ডে দেয়ালে রুটি ছুড়ে মেরে, বার্মাতে একটি জল উৎসবে পানি ছুড়ে, ইতালীতে মসুরডাল খেয়ে, বলিভিয়াতে মিষ্টি জাতীয় দ্রব্যের মধ্যে কয়েন রেখে সেটি আগুনে সেঁকার মাধ্যমে, রোমানিয়াতে কোন নদীর পাশে কয়েন টস বা ঊর্ধ্ব নিক্ষেপনের মাধ্যমে, তুর্কিতে নিজেদের ঘরের দরজায় ডালিম ভাঙার মাধ্যমে নতুন বছরটি সৌভাগ্য নিয়ে আসবে বলে মনে করে। বাংলাদেশ ভারতসহ উপমহাদেশীয় দেশগুলোতে অনেক ধরনের বিচিত্র প্রথার প্রচলন রয়েছে যেগুলো মানুষ পালন করে থাকে এই আশায় যেন তাদের নতুন বছরটি হ্যাপি বা শুভ হোক অর্থাৎ সৌভাগ্যের হোক। দেশে দেশে নতুন বছর এ তো গেল দেশব্যাপী নিউ ইয়ার উদ্যাপনের বিবিএ সব তথ্য এবার আরেকটি তথ্য পাঠকদের নিশ্চয়ই অজানা নয় যে, নতুন বছর মানে শুধু জানুয়ারি ১ তারিখ দিয়ে শুরু হয় তা নয়। বিভিন্ন দেশে নতুন বছর বিভিন্ন সময়ে শুরু হয় আবার সে অনুযায়ী উদযাপিতও হয়। এই যেমন রয়েছে চাইনিজ, জাপানিজ, ইহুদি, কম্বোডিয়ান, ইউরোপিয়ান সহ বাংলা নববর্ষও। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময় নতুন বছর উদ্যাপন করে থাকে। আমাদের বাংলা অন প্রবর্তন করা হয় ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। এভাবে আসলে এটি স্বাভাবিক এর প্রচলিত বিভ্রান্তি থেকেই যায় যে, প্রকৃতপক্ষে মানব জীবনের বা মনুষ্য সমাজের নতুন বছর আসলে ঠিক কখন থেকে শুরু হয়। শুধু মানুষ কেন আমাদের আশেপাশের পশু-পাখি, তথা গাছ-পালা এইসমস্ত পৃথিবীর নতুন বছর আসলে শুরু হয় কবে থেকে এ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন কিন্তু একজন বুদ্ধিমান হাজির করা উচিত। কেননা বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা কখনো অন্ধভাবে কোন কিছু অনুসরণ করে না, তারা প্রকৃত উৎসের সন্ধান করতে চায়। করে থেকে নতুন বছরের শুরু? তিল, পল, মুহূর্ত, দণ্ড, প্রহর, দিবস, রজনী, সপ্তাহ, মাস, বছর, যুগ, শতাব্দী ইত্যাদি মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহারোপযোগী সময়ের বিভিন্ন বিভাজন । কিন্তু কখন থেকে সময় শুরু হল? প্রশ্নের উত্তর প্রদানের পূর্বে জানা দরকার এই কাল কে সৃষ্টি করেছেন? শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (১১/৩২) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ‘কালোহস্মি লোকক্ষয়কৃৎ প্রবৃদ্ধো’ অর্থাৎ, আমি (শ্রীকৃষ্ণ) লোকক্ষয়কারী প্রবৃদ্ধ কাল” তাহলে যে প্রকৃত উৎসের কথা বলা হয়েছিল ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হল সেই উৎস যার কাছ থেকে সময় বা কাল উৎপত্তি হয়েছে। এখন প্রশ্ন হল কবে থেকে এ কাল শুরু হয়েছে? উত্তরটি হল অনাদিকাল আগে থেকে, তবে অগণিত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কথা বললে, এর আয়ুষ্কাল হল ৩১১ ট্রিলিয়ন ৪০ বিলিয়ন বছর এবং এটি বর্তমানে ১৫৫.৫২২ ট্রিলিয়ন বছরের পুরানো। এই গণনাটি ব্রহ্মার আয়ুষ্কাল অনুসারে আর ব্রহ্মার জীবনাবসানে এই ব্রহ্মাণ্ডের ইতি ঘটে। সময়ের এই হিসাব অনেকেরই অজানা। অর্থাৎ বলতে গেলে জীবাত্মার নতুন বছর যে কবে শুরু হয়েছিল তা অজানা। উল্লেখ্য জীবাত্মার ধ্বংস নেই বরং এই শরীরটির ধ্বংস হয়। অর্থাৎ যখন থেকে জীবাত্মা তার নিত্য ধাম থেকে এ জড়জগতে পতিত হয় তখন থেকেই তার নতুন বছর শুরু হয় আর এ জড় জগৎ সৃষ্টি হয় তারও অনেক অনেক পূর্বে। এই হল সময়ের সংক্ষিপ্ত ধারণা। অর্থাৎ নতুন বছর বলতে আমরা যা পালন করি তা প্রকৃত অর্থে মানুষের তৈরি। প্রকৃত নতুন বছর উদযাপন ও পরম সৌভাগ্য এবার আসা যাক উদযাপন নিয়ে। এই প্রবন্ধের শুরুতে যে বৈচিত্র্যময় উদ্যাপনের তথ্যাবলী দেওয়া হয়েছিল তার প্রধান উদ্দেশ্য হল যেন নতুন বছরটি সৌভাগ্যের হয়। অর্থাৎ সবাই এতটুকু উপলব্ধি করেছে এই জড় জগত প্রকৃতপক্ষে দুঃখময় স্থান তা যদি না হত তবে পরস্পর পরস্পরকে বলতো না। ‘আপনার নতুন বছরটি শুভ হোক, সৌভাগ্যের হোক” এর প্রমাণ ভগবান স্বয়ং বলেছেন, দুঃখালয়ম শাশ্বতম (গীতা ৮/১৫) অর্থাৎ এ জড়জগত দুঃখালয় ও অনিত্য। এখান থেকে আরেকটি বিভিন্ন অলীক প্রথায় আমরা হয়ত নতুন বছর শুভ হোক তা প্রত্যাশা করতে পারি, কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম যে এটি সর্বদা দুঃখময় তা কখনো পরিবর্তন করতে পারব না। অর্থাৎ এ সময় অলীক উদযাপনের পরও আমাদের জন্য নতুন বছরে কোন না কোন দুঃখ নিশ্চিতভাবে অপেক্ষা করছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল আমরা যে দুঃখে রয়েছি কিংবা দুঃখটা কি সেটিই আবার অনেকে উপলব্ধি করতে পারে না।
যাহোক, তবে ভগবান যদিও বলেছেন এটি দুঃখময় স্থান, আশার সংবাদ হল ভগবান বলেছেন এই দুঃখময় স্থানেও কেউ প্রকৃত সৌভাগ্য লাভ করতে পারে। এ বিষয়ে ভগবান গীতায় (১৮/৬৫-৬৬) ভগবৎ ভক্তির পদ্ধতি সম্পর্কে উল্লেখ যা অবলম্বন করলে যে কেউ আনন্দময় হয়ে উঠতে পারে। শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন, “আমাদের প্রতিটি দিনই একটি নতুন বছর। নব-নবযৌবন। আমাদের এই কৃষ্ণভাবনাময় পদ্ধতি এতই চমৎকার যে, কেউ যদি এটি অনুশীলন করতে করতে অগ্রসর হয় তবে তার কাছে মনে হবে প্রতিটি দিনই নতুন নতুন বছর। এই হল বিষয়। কোন কিছুই পুরানো নয়। অনেক সময় সাধারণ লোকেরা ভাবে তারা (কৃষ্ণ ভক্তরা শুধু পুরানো এই শ্লোগান ‘হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ-কীর্তন করেন, তাহলে কয়েক ঘন্টা পর এটি করতে ভালো লাগবে না। কিন্তু এই ‘হরেকৃষ্ণ’ মহামন্ত্র আমরা অবিরত জপ-কীর্তন করতে পারি। যদি আমরা এটি করে নতুন নতুন কোন আনন্দ লাভ করতে না পারি। তবে কেন আমরা তা করব?
(প্রাতঃভ্রমণ, লস্ এঞ্জেলেস্ ৩ জানুয়ারী, ১৯৭৪) অর্থাৎ একমাত্র কেউ যদি এমনকি ইংরেজী নববর্ষকে কোন উদ্ভট পন্থায় নয় বরং প্রামাণিক ও পরম্পরা অনুমোদিত এই ‘হরেকৃষ্ণ’ মহামন্ত্র জপ-কীর্তনের মাধ্যমে বরণ করি তবে সেদিন থেকেই বছরটি নব নব আনন্দ বা সৌভাগ্য দিয়ে শুরু হবে। সৌভাগ্য তো ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির কাছে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে তবে পরম সৌভাগ্য সবার জন্যই একই পরমানন্দের অনুভূতির সঞ্চার করে।
পরিশেষে শ্রীমৎ রাধানাথ স্বামীর নতুন বছর উদ্যাপন নিয়ে কিছু উপদেশ যা নতুন বছরে নতুন দিকদর্শন নিয়ে আসবে। তিনি বলেছেন, “শ্রীল প্রভুপাদ উল্লেখ করেছেন, আমাদের জন্য প্রতিটি দিনই নতুন বছর, কারণ কৃষ্ণ হল চিরসতেজ ও চিরনবীন এবং আমরা তাকে ঘিরেই সব উদ্যাপন করি । কিন্তু অনেক জাগতিক লোকে পুরানো বছরের হতাশা, দুর্দশা ভোলার জন্য তমগুণের অধীনে বিষ পান করে অর্থাৎ মদ্যপ হয়ে উদযাপন করে, অথচ আমরা উদযাপন করি হরিনাম রূপ অমৃতসুধার প্রতি আসক্ত হয়ে।
উপরন্তু বৈদিক ঐতিহ্য অনুসারে এটি নতুন বছর না, বৈদিক দিন পঞ্জিকা অনুসারে দীপাবলী হল নতুন বছরের প্রথম দিন যেদিনে আলোক সজ্জা পূজা, মিষ্টি বিতরণ, উপহার বিতরণ, নতুন বস্ত্র পরিধান করে উদযাপন করা হয়। কিন্তু বর্তমানে লোকেরা কোন নতুন বছর উদযাপন করে মদ্যপ হয়, বমি করে পরের দিন পর্যন্ত ঘুমে কাটিয়ে এভাবেই তারা নতুন বছরকে বরণ করে নেয়, এটি হল পশ্চিমা সংস্কৃতি, লোকেরা বিশেষত খ্রিষ্টীয় দিনপঞ্জিকা অনুসারে নতুন বছর উদযাপন করে কারণ একসময় সময় দেশগুলো ব্রিটিশ, ইউরোপীয়ান শাসনাধীন ছিল, আর তারা এই নোংরা সংস্কৃতিগুলো সব জায়গায় এভাবে ছড়িয়ে দিয়েছে।
একজন ভক্ত ধ্যান করতে পারে এভাবে যে আমি ভগবান কৃষ্ণকে লাভ করার জন্য একটি সীমিত সময় পেয়েছি এবং আমি নতুন বছরের মাধ্যমে মৃত্যুর আরও এক বছর কাছে চলে আসলাম। আর তাই। আমাদেরকে আরো একনিষ্ঠ ও দৃঢ় হতে হবে হরিনাম জপ এবং শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থাবলীর আশ্রয় গ্রহনের মাধ্যমে। আমরা নতুন বছরকে মঙ্গল আরতি, ভক্ত সঙ্গে জপ-কীর্তন, মন্দির পরিদর্শন গুরুদেব ও শ্রীল প্রভুপাদের কাছ থেকে কৃষ্ণকথা | শ্রবণের মাধ্যমে উদযাপন করি। বৈদিক নির্দেশে আছে সর্বে সুখিনো ভবন্তু সকলেই। সুখী হোক। শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন, “এটিই বৈদিক ব্রত।” এভাবে সবার জন্য কামনা করছি অত্যন্ত সুখী ও কৃষ্ণভাবনাময় নতুন বছর। ” হরে কৃষ্ণ!
তথ্য সূত্র: উইকিপিডিয়া, রিডার্স ডাইজেস্ট, বিবিসি, প্রভুপাদ কানেক্ট ডট কম, বানীকোটস্ ডট অরগ।
01/01/2022