এই পোস্টটি 244 বার দেখা হয়েছে
সুইডেনে অধিকাংশ লোকই গীর্জাতে যায় না। সে ক্ষেত্রে আমার পিতা-মাতাও ধার্মিক কিংবা দার্শনিক নয়, কিন্তু আমার প্রেক্ষাপট থেকে বললে আমি যতটুকু সম্ভব ভগবানকে স্মরণ করি এবং ভগবানে বিশ্বাসও করি। আমার বয়স যখন আট কি নয়, তখন প্রকৃতির মনোরম দৃশ্যাবলী, সরোবর, আকাশে মেঘেদের বিচরণ এসব দেখে অনুভব হতো যে, এসবের পেছনে কেউ না কেউ রয়েছে, কোনো উন্নত বুদ্ধিমত্তা।
যদিও ছোটবেলা থেকে চিত্রকলা ছিল আমার সেরা বিষয়, তবে আমার কোনো ধারনাই ছিল না যে, পরবর্তীতে আমি একজন আর্টিস্ট বা চিত্রশিল্পী হয়ে উঠব। আমি তখন জীবনের উদ্দেশ্য অনুসন্ধান করতে চাইতাম যেটি আমার কাছে তখন অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। আমি ভগবৎভাবনার অনুসন্ধান করছিলাম, সেসময়, চিত্রশিল্পের প্রতি আমার আগ্রহকে ভগবভাবনার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করিনি।
যখন আমি শ্রীল প্রভুপাদের একটি গ্রন্থ শ্রীঈশোপনিষদের প্রচ্ছদে অঙ্কিত কেশব প্রভুর চিত্রকর্ম প্রথম দেখি, তখন আমি ভাবি, “এটি সত্যিই বিশেষ কিছু, যদি ভগবান থেকে থাকে, তবে তাঁকে বিশেষ কিছু হতে হবে।
তিনি বিশেষ ব্যক্তিত্বের অধিকারী হবেন।” আমার এই অনুভূতি ছিল যে, ভগবান হলেন একজন ব্যক্তি। আমি তখনও গ্রন্থটি অধ্যয়ন করিনি, কিন্তু সেই চিত্রকর্মটি আমাকে অনেক কিছু বলেছিল । “ইনি অবশ্যই ভগবান”।
একসময় আমি ব্যাক টু নেচার নামে একটি উৎসবে গিয়েছিলাম এবং ভক্তরা সেখানে বসে গান গাইতে লাগলো। উৎসবটি খুবই আকর্ষনীয় ছিল, সেখানে শব্দ তরঙ্গ ও ‘হরে কৃষ্ণ’ মহামন্ত্র আমার হৃদয়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিল এবং আমি তখন উপলব্ধি করলাম, এই হল পরম সত্য। এটি উপলব্ধির জন্য আমার কোনো লেকচার শোনার কিংবা পারমার্থিক জ্ঞান লাভেরও প্রয়োজন ছিল না। আমি তখন আমার অনুভূতি এবং ব্যক্তিগত সংস্কারের মাধ্যমে পারমার্থিক বিষয়গুলো খুঁজি। এটি এমন সুন্দর এক অভিজ্ঞতা ছিল।
চিত্রশিল্পের প্রতি আমার আগ্রহ সবসময়ই ছিল তবে সেটি সুপ্তভাবে। এটি আমার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রতোভাবে জড়িত ছিল। কিন্তু এ পর্যায়ে এসে আমার অনুভব হয়, আমার সেই আগ্রহ পূর্ণ বিকশিত হওয়ার সুযোগ লাভের জন্যেই এতদিন প্রতীক্ষা করেছিলাম। আমি জানতাম যে, চিত্রশিল্পের মাধ্যমে আমি কিছু প্রকাশ করতে পারব।
আমার বয়স তখন ২০, ১৯৭৮ সালে হরেকৃষ্ণ আন্দোলনের সাথে যোগদান করি। তখন এই চিত্রশিল্পের বিকাশের জন্য জোরারোপ ছিল না। আমি তখন গ্রন্থ বিতরণ, বিগ্রহ অৰ্চন, মন্দিরের সেবায় ব্যস্ত ছিলাম। একসময় আমার বিয়ে হয় এবং একটি সন্তানও হয়। সে দিনগুলোর প্রতি আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। কারণ ভক্তিযোগ হল পরিশুদ্ধিকরণের পন্থা এবং পরবর্তীতে একসময় অনুভব করি কৃষ্ণভাবনার জন্য চিত্রশিল্প হল উত্তম মাধ্যম। এ বিষয়ে কিভাবে উন্নতি লাভ করা যায় সেই প্রয়াস করতে থাকি।
কৃষ্ণভাবনার শুরুর দিকে আমি কি করেছিলাম আর এখন কি করছি এ বিষয়ে আমি পর্যবেক্ষণ করি। আমি তখন অনুভব করি, নিজেকে কৃষ্ণভাবনায় প্রগতিতে আরও উত্তমরূপে বিকশিত করতে পারব। যদিও আমি খুব বেশি অনুশীলন করি নি, আমার অনুভব হয় যে, পারমার্থিকতার প্রতি আমি যতই ধাবিত হচ্ছি, ততই আমার চিত্রশিল্প আরো উন্নতর হচ্ছে।
আমি খুশি ছিলাম এজন্য যে, এই চিত্রশিল্পের মাধ্যমে আমার কৃষ্ণভাবনা এবং এর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস প্রকাশ করতে পারব। কারণ, কৃষ্ণভাবনা হল এমনই ঐশ্বর্যময়।
আমি জল রঙের চিত্রকর্ম পছন্দ করি। এটি সুন্দর একটি মাধ্যম এবং অত্যন্ত রুচিকর। এতে বিভিন্ন রঙের ব্যবহার এমন সুন্দর হয়ে উঠে। আপনি এর মাধ্যমে অত্যুন্নত (Lofty) এবং সপ্নীল ও গূঢ় (Esoteric) বিষয় প্রকাশ করতে পারবেন। চিত্রকর্মের মাধ্যমে আপনি নিজের অভিব্যক্তি তুলে ধরতে পারেন। এটি নিজের ভিতর থেকে আগত হয়। এক্ষেত্রে আপনি পারমার্থিক প্রেক্ষাপট থেকে কিভাবে চিত্রকর্ম প্রদর্শন করবেন? জড়জাগতিক প্রেক্ষাপটের চেয়ে চিন্ময় প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন, যদিও জড়জগত থেকে আমরা চিন্ময় জগতের ধারণা পেতে পারি। জল রঙ হল পারমার্থিক প্রেক্ষাপট অংকনের জন্য উৎকৃষ্ট।
আমার এই বিশ্বাসটি রয়েছে যে, প্রতিটি ব্যক্তির মাঝে কোনো না কোনো বিশেষ গুণ রয়েছে, সেটি তার নিজের জন্য কিংবা সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি বিশেষ উপহার। এক্ষেত্রে সেই উপহারটি সম্পর্কে জানতে হয়তো কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হয়। তবে অবশেষে যখন আপনি এটি আবিষ্কার করবেন, তখন আপনি আরো স্বয়ং সম্পূর্ণ ও সন্তোষজনক জীবন লাভ করতে পারেন। কেননা আপনি তখন আপনার নিজের কোনো অদ্বিতীয় গুণ সম্পর্কে জানেন “ওহ, দেখুন আমাকে, আমি এটা বা ওটা।” কিন্তু যখন আপনি এটি উপলব্ধি করেন যে, এই উপহারটি ভগবান কর্তৃক প্রদত্ত এবং তখন আপনি সেই উপহারটিকে ভগবানের সেবায় ব্যবহার করতে চাইবেন।
যদি আপনি কৃষ্ণভক্ত হোন তবে স্বভাবতই আপনি এই কৃষ্ণভাবনা সবার মাঝে প্রচার করতে চাইবেন। কেউ পারমার্থিক জ্ঞান প্রদানের মাধ্যমে বা পারমার্থিক ম্যাগাজিন তৈরি করার মাধ্যমে কিংবা শিক্ষক হওয়ার মাধ্যমে অথবা শিশুদের যত্ন বিধানের মাধ্যমে এই কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচার করতে পারেন। এক্ষেত্রে আমি বেছে নিয়েছি চিত্রশিল্পকে।
এই হল আমার জীবন আমার চিত্রকর্মে ফুটে উঠে, কৃষ্ণই হল আমার জীবন ও প্রাণ। কৃষ্ণ অনেক সুন্দর।
আমি ১৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই দেশে (সুইডেনে) অবস্থান করছি। এখানকার পরিবেশ আমাকে ভালোভাবেই প্রভাবিত করে। আমার এখানকার আকাশ ও বৃক্ষরাজি দেখতে ভালো লাগে। আমার চারপাশের ভারসাম্যতার ওপর আমি নির্ভর করি। যদি আমি ভারসাম্যে না থাকি, তবে আমি মনে করি না যে চিত্রশিল্প নিয়ে আমি বেশি দূর এগুতে পারব। বছরের পর বছর পারমার্থিক জীবন ধারার মধ্য দিয়ে নিজেকে একটি ভারসাম্য অবস্থায় উপনীত করেছি।
একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে কৃষ্ণভাবনা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। যদি আপনি কৃষ্ণের কোনো চিত্রকর্ম অংকন করেন, তবে তখন সেটি চিন্ময় হয়ে যায়। কৃষ্ণ হলেন একজন চিন্ময় পুরুষ। এজন্যে কৃষ্ণের চিত্রকর্ম অংকনের ক্ষেত্রে আমি অনুভব করি যে, পারমার্থিক জীবনধারার প্রতি আমাকে অত্যন্ত একনিষ্ট হতে হবে। আমার চিত্রকর্মগুলো জীবন্ত হওয়ার জন্য কৃষ্ণের কাছে আমাকে বলতে হবে, “হে কৃষ্ণ, আমি আপনার সেবক। অনুগ্রহ করে আমার নিজের উপলব্ধি প্রকাশের ক্ষেত্রে এবং আপনাকে অংকন করতে আমাকে সহায়তা করুন। এই চিত্রকর্ম পন্থাটি আমার অত্যন্ত পছন্দের যার মাধ্যমে আমি আপনার প্রতি সেবা নিবেদন করতে পারি।” আমি দেখি যে, এরকম অনেক ব্যক্তি রয়েছে তাদের পক্ষে এটি উপলব্ধি করা অত্যন্ত কঠিন যে, পরম সত্য হলেন একজন ব্যক্তি। এক্ষেত্রে ভগবানের গায়ের রঙ নীল, তিনি বংশী বাজান এবং ভগবান সম্পর্কে আরো তথ্য ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে অন্যের ওপর যে প্রভাব পরিলক্ষিত হয় তার সমান প্রতিক্রিয়া কেউ লাভ করতে পারে ঐ একই বিষয়সম্বলিত কোনো চিত্রকর্মের মাধ্যমে। যখন কেউ এরকম চিত্রকর্ম দেখে, তখন তিনি কৃষ্ণের অপরূপ সৌন্দর্যকে গ্রহণ করে। এই পন্থায় কৃষ্ণ তাঁর সাথে কথা বলতে পারে।
কৃষ্ণভাবনার উদ্দেশ্য হল মনকে কৃষ্ণভাবনায় নিবদ্ধ করা, ভাবুন তো, আপনি কৃষ্ণ সম্বন্ধীয় কোনো কিছু আঁকার অভিলাষ করেছেন। সেক্ষেত্রে আপনার মনের মধ্যে কৃষ্ণের অতীত লীলাবিলাসের ধ্যানে পূর্ণ করুন। কৃষ্ণের একটি প্রতিচ্ছবি নিজের মধ্যে তৈরি করুন, কিভাবে তিনি বস্ত্র পরিহিত হয়ে আছেন এবং কিভাবে তিনি পুষ্পমাল্য ধারণ করে আছেন এবং আপনি সেই পুষ্পের আঘ্রান প্রায় আস্বাদন করছেন সেই সাথে তাঁর কেশরাজি এবং তাঁর দিব্যভাব ও ভক্তদের সঙ্গে তাঁর লীলাবিলাস দর্শন করছেন। এভাবে চিত্রশিল্প হল একটি ধ্যানমূলক বিষয়।
সুইডেনের একটি বৈদিক ফার্মে অনেক দিন বাস করার পর, অন্নপূর্ণা দেবী দাসী বর্তমানে পেনসিলভিয়ার ফিলাডেলফিয়াতে তার পতি যোগীন্দ্র দাস ও তাদের কন্যা বৃন্দার সঙ্গে অবস্থান করছেন।
এপ্রিল-জুন ২০১৫ ব্যাক টু গডহেড