কতিপয় শিষ্য ও অতিথিগণের মধ্যে এই আলাপ আলোচনাটি বিনিময় হয়েছিল ১৯৭৫ এর জুলাই-এ, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্কেলি প্রাঙ্গণে প্রাতঃভ্রমণের সময়।
অতিথি : শ্রীল প্রভুপাদ, এক মাস পূর্বে খবরের কাগজে একটি | পাগলামি গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে ছিল একটি তরুণ ছাত্র পারমানবিক বোমা তৈরি করার জন্য ওয়াশিংটন ডি. সি. পাবলিক লাইব্রেরির লেখ্যাগারে প্রবেশ করে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করেছিল। সুতরাং এখন অনেক নেতারা ভীত সন্ত্রস্ত যে, কিছু বছরের মধ্যে যে কোন সন্ত্রাসবাদী দল তাদের নিজস্ব পারমানবিক বোমা তৈরি করতে সক্ষম হবে।
শ্রীল প্রভুপাদ : হ্যাঁ, সেটা হতে পারে…….
অতিথি : ওঃ, আপনি কি ঐ টাওয়ারটি দেখেছেন? ছাত্ররা যে এখান থেকে লাফা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তা সকলের কাছেই পরিচিত। বস্তুত, সমগ্র দেশের বিদ্যালয়গুলিতে বেশ কিছু সংখ্যক ছাত্ররা আত্মহত্যাকে বরণ করে নিচ্ছে।
শ্রীল প্রভুপাদ : হ্যাঁ। তারা প্রকাশ্যে আত্মহত্যা করছে এবং বাকি লোকেরা গোপনে আত্মহত্যা করছে। এই লোকটি যে অনুসন্ধান করে বেড়াচ্ছে কিভাবে পারমানবিক বোমা বানানো যায়? সে মনে করছে যে এখন তার জীবন সফল। কিন্তু সে যদি তার মানব জীবনে পারমার্থিক উপলব্ধির চেষ্টার জন্য ব্যয় না। করে, তা হলে সেও আত্মহত্যা করছে।
অতিথি : সেটা কি রকম?
শ্রীল প্রভুপাদ : যেহেতু সে তার নিজের মৃত্যু এবং পুনর্জন্ম থেকে নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হচ্ছে না।
অতিথি : কৌতূহলজনক যে, বৈজ্ঞানিকেরা মূলত মৃত্যুকে রোধ করতে পারমানবিক বোমার উন্নতি সাধন করেছিল- যত শীঘ্রই। সম্ভব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে শেষ করে দিতে। শ্রীল প্রভুপাদ : মৃত্যুকে কিভাবে তারা রোধ করতে পারে? ওরা জানে না এটাকে কিভাবে রোধ করতে হয়। বরং তারা মৃত্যুকে বাড়াতে পারে, এটুকুই। বৈজ্ঞানিক মহাশয়, এই হচ্ছে আপনার [ সমস্যা, জন্য মৃত্যুজরাব্যাধি-জন্ম, মৃত্যু, জরা ও ব্যাধির চক্র। এর সমাধান করুন! যারা পারবে সে সব বৈজ্ঞানিকেরা কোথায়? এর পরিবর্তে তারা কতকগুলি শিশুসুলভ সমস্যার দায়িত্ব নিবে এবং প্রকৃত সমস্যাটিকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করবে। কিন্তু তারা এটাকে এড়িয়ে যেতে পারে না, কারণ কৃষ্ণ এটাকে প্রকাশ্যে সকলের সামনে উত্থাপন করেছে— ‘জন্মমৃত্যুজরাব্যাধিদুঃখদোষানুদর্শনম্’- “প্রকৃত দ্রষ্টা জন্ম, জরা ও ব্যাধিকেই সমস্যা হিসাবে দেখবে।” কিন্তু বৈজ্ঞানিকদের কোন উত্তর নেই, এই সমস্যার কোন সমাধান নেই। কোথায় সেই জৈব রসায়নবিদ, মনস্তত্ত্ববিদ অথবা পারমাণবিক পদার্থবিদ্যাবিদ যারা এই সমস্যার সমাধান করতে পারে।
শিষ্যঃ আজকাল তাদের একটা মতবাদ আছে যে, পারমাণবিক অস্ত্রের দ্রুত বৃদ্ধির ফলে এখন রুশদের হাতে বহু অস্ত্রশস্ত্র, চীনের হাতে বহু রকমের অস্ত্রশস্ত্র, আমেরিকার হাতে পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র, প্রত্যেকেই ভীত ও সন্ত্রস্থ সেগুলির প্রয়োগের ব্যাপারে। শ্রীল প্রভুপাদ ঃ তারা অবশ্যম্ভাবীরূপে এমনকি এখন গরিব মানুষও গাড়িতে চড়ে প্রায় সব জায়গায় যায় এবং এক ইঞ্চি পথ পর্যন্ত হাঁটতে খুব কম দেখা যায়- কারণ প্রচুর গাড়ির ব্যবস্থা আছে। সুতরাং, যেহেতু এখন প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র হাতে, সেগুলির প্রয়োগ অবশ্যই হবে। সেটাই হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিণাম।
অতিথি : কিন্তু প্রত্যেকটি দেশ জানে যে, পারমাণবিক যুদ্ধের অর্থই হচ্ছে সম্পূর্ণ ধ্বংস।
শ্রীল প্রভুপাদ : হতে পারে, সমগ্র অথবা আংশিক তা আমরা দেখব। কিন্তু অস্ত্রের প্রয়োগ হবেই….. সব কিছুর মীমাংসার সমাধান হতে পারে তিনটি বিষয় জানার মাধ্যমে ভগবান হচ্ছেন মালিক, তিনি হচ্ছেন ভোক্তা এবং তিনিই একমাত্র সকলের সুহৃৎ । কিন্তু বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক ও রাজনীতিবিদরা কাজ করছে ঠিক তার উল্টো ধারণার বশবর্তী হয়ে-“আমি হচ্ছি মাণিক, আমি হচ্ছি ভোক্তা, এবং আমি সুহৃদ-কারণ “আমি হচ্ছি ভগবান।” আপনি তো তা দেখছেনই? এবং প্রত্যেকেই যে বলছে সে হচ্ছে জনসাধারণের সুহৃদ বা হিতৈষী কিন্তু অন্তিমে তাদের শত্রু বলে প্রমাণিত হচ্ছে। রাষ্ট্রপতি নিক্সন ভোট সংগ্রহ করেছিল একজন হিতৈষীর তান করে, এবং পরবর্তীকালে সে শত্রু হিসেবে প্রমাণিত হল……… প্রত্যেকেই……… গান্ধী একজন সুস্থল বা হিতৈষীরূপে জ্ঞান করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত একজন শত্রুরূপে প্রমাণিত হলেন। অন্যথায়, কেন তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন? লোক যদি তাকে শত্রু মনে না করতেন, তা হলে তিনি গুলিবিদ্ধ হলেন কেন? সুতরাং কৃষ্ণ ছাড়া কেউই আপনার যথার্থ হিতৈষী হতে পারে না।
শিষ্য: কিন্তু ভগবানের শুদ্ধ ভক্ত তিনি একজন সকলের হিতৈষী…..
শ্রীল প্রত্নপাদ : কারণ তিনি কৃষ্ণের বাণী বহন করেন। কৃষ্ণ সকলের হিতৈষী এবং শুদ্ধ ভক্ত তাঁর বন্ধুর বাণী বহন করছেন। তাই তিনি একজন বন্ধু। কেউ যদি উত্তম বন্ধু থাকেন আর কেউ যদি সেই উত্তম বন্ধুর খোঁজখবর দেয়, সেও একজন সুহৃদ। সুতরাং কৃষ্ণ বা কৃষ্ণের প্রতিনিধি ছাড়া কেউই যথার্থ সুহৃৎ হতে পারে না। জড়- জাগতিক জীবনের অর্থ হচ্ছে, “আমি তোমার শত্রু এবং তুমি আমার শত্রু। হিংসা এবং শত্রুতা-এটাই হচ্ছে জড় জগতের সমগ্র গঠন। সুতরাং শত্রু কিভাবে একজন বন্ধু হতে পারে? এটা ভান বা প্রতারণা।
শিষ্য: যখন আমরা বাইরে যাই আপনার বইগুলি বিতরণ করতে, আমরাও লোকদের সাহায্য করছি ভগবানকে জানতে। তাহলে তো আপনার শিষ্যরাও তাদের প্রকৃত বন্ধু।
শ্রীল প্রভুপাদ : ওহ্যাঁ। সেটাই হচ্ছে প্রকৃত বন্ধুত্ব। তোমরা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভূর (কৃষ্ণের অতি সাম্প্রতিক কালের অবতার, যিনি পাঁচ শতাব্দী পূর্বে ভারতবর্ষে আবির্ভূত হয়েছিলেন) বাণী জনসাধারণকে দিচ্ছে- কত নিদ্রা যাও মায়া-পিশাচীর কোলে এনেছি ঔষধি মায়া নাশিবার লাগি। হরিনাম মহামন্ত্র লও তুমি মাগি “জনসাধারণ সর্বত্রই, তোমরা নিদ্রা যাচ্ছ ‘মায়া’র অধীনে। কত কাল তোমরা মায়ার কবলে ঘুমাবে এবং এই জগতে মৃত্যু ও পুনর্জন্মের কবলে দুঃখকষ্ট ভোগ করবে? আমি তোমার জন্য শাশ্বত, চিন্ময় ঔষধ এনেছি। এটা গ্রহণ কর এবং আর ঘুমিয়ে থেকো না হরিনাম মহামন্ত্র লও তুমি মাগি “এখন হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র গ্রহণ কর-এটা হচ্ছে তোমার ঔষধ।”
অতিথি : তাহলে কি এই জড় জগতের সমস্ত রকমের সম্বন্ধ শত্রুতার উপর প্রতিষ্ঠিত? বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক ও রাজনীতিবিদরা জোর দিয়ে বলে থাকে প্রেমের উপর।
শ্রীল প্রভুপাদ : সেটা প্রেম নয়। সেটা হচ্ছে কাম-“আমার কামনা বাসনা যেইমাত্র অপূর্ণ হবে, তখনই আপনি হচ্ছেন আমার শত্রু।”
অতিথি : যদিও কখনও কখনও মনে হয়, বস্তুত এই লোকগুলির হৃদয়ে রয়েছে আমাদের জন্য মঙ্গলময় স্বার্থচিন্তা।
শ্রীল প্রভুপাদ : কখনও কখনও আমরা দেখতে পাই, একটি কুকুর জলে সাঁতার কাটছে এবং আমরা চিন্তা করতে পারি, “ওঃ আমাকে তার লেজটি ধরতে দিন এবং পার হই।” একইভাবে, | যারা মনে করছে তথাকথিত বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিকেরা অথবা অন্য কোন জড়-জাগতিক ব্যক্তি তাদের সমস্যাগুলিকে সমাধান করবে সেটা ঠিক কুকুরের লেজ ধরে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দেবার মতোই।