এই পোস্টটি 217 বার দেখা হয়েছে
স্পেনের কারাগারও ভক্তদের ভক্তিমূলক সেবা কেড়ে নিতে পারেনি
শ্রীমৎ ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বামী
একসময় আমার কারাগারে থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছিল, কারণ আমি সত্তরের দশকে একটি গুরুতর অপরাধ করেছিলাম। সেটি তৎকালীন স্পেন সরকারের চোখে যে জিনিসটা করেছিলাম তা হল আমি ও কিছু ভক্ত মিলে স্পেনের রাস্তায় হরে কৃষ্ণ কীর্তন করেছিলাম। এই অপরাধের জন্য আমি সহ নয়জন ভক্তকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করেছিল।
যখন পুলিশ আমাদের গ্রেপ্তার করে তখন তারা আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে, “জান তোমরা কি অপরাধ করেছ? এবং এজন্য তোমাদের কি শাস্তি হবে? তোমরা কি জান না যে, রাস্তায় ভারতীয় গান গাওয়া কোন পারমার্থিক বিষয় হতে পারে না? কারণ ভগবান হলেন যীশুখ্রীষ্ট, তাই তোমাদের শাস্তি পেতে হবে এবং এরপর যখন আমাদের আদালতে আনা হল, জর্জ আমাদের কোন কথা শোনার পরোয়া না করেই বললেন, “অনির্দিষ্টকালের জন্য তাদেরকে কারাগারে প্রেরণ করা হোক এবং ওদের পাসপোর্ট জ্বালিয়ে দেওয়া হোক।” তারা তাই করল ।
এরপর আমাদেরকে কারাগারে প্রেরণ করা হল। ডাবল চেম্বারে মাত্র দুই জন কয়েদী থাকতে পারে এমন সেলে আমাদের নয় জনকে রাখা হল। শুধু ডাবল চেম্বারই ছিল না, আমাদের সাথে আরো ছিল ৪টি ইঁদুর, অনেক তেলাপোকা ও অগণিত মাছি। এর মাঝে আমরা একত্রে বাস করছিলাম । পড়নে একটি গামছা ছাড়া আর কোন বস্ত্র আমাদের দেওয়া হয়নি। তবুও আমরা এরকম বিরূপ পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিচ্ছিলাম। আমরা সকালের কর্মসূচী অর্থাৎ মঙ্গলারতি থেকে শুরু করে সবকিছুই করছিলাম ।
প্রতিদিন কারাগারেই আমরা নৃত্য কীর্তন করতাম। অথচ এই নৃত্য কীর্তনের তথাকথিত অপরাধের জন্য আমাদের কারাগারে রাখা হয়েছিল। এজন্য একসময় কারারক্ষীরা গরম জল নিয়ে আসত আর বলত, “যদি তোমরা এসব বন্ধ না কর, তবে আমরা গরম জল ঢেলে দিতে বাধ্য হব।” আর তখন আমাদের নৃত্য কীর্তন বন্ধ হয়ে যেত। অবশ্য কারাগারে আমাদের কঠোর সময়সূচী ছিল। প্রতিদিন ভোর চারটায় শয্যা ত্যাগ করে সবাই মঙ্গলারতি করতাম এবং পর্যায়ক্রমে সব কিছু অগ্রসর হত। প্রকৃতপক্ষে ঐ সময় যে অপ্রাকৃত কীর্তন হত তা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে অপ্রাকৃত কীর্তন। কারণ সবকিছু নির্ভর করে হৃদয় থেকে উৎসারিত পবিত্র হরিনামের প্রতি আশ্রয় গ্রহণের মাধ্যমে। আমি প্রতিদিন সকালে শ্রীমদ্ভাগবত ক্লাস দিতাম এবং ভক্তরা মুখে মুখে সবকিছু শিখত। কোন কিছু অতিরিক্ত হত না, সব আমরা কারাগারের বাইরে যেরকম করতাম হতো। ভাগবত ক্লাসের পর আমরাই নিজ নিজ আহার প্রস্তুত করতাম। কারণ কারাগারে যে খাবার আমাদের দেওয়া হত তা হল কিছু পোকামাকড়সহ রুটি। প্রতিদিন সকালে মানসে আমরা ১০৮ প্রকার ভোগ ভগবানের জন্য প্রস্তুত করতাম। মানসে ভগবানের পূজা করতাম, সংকীর্তনে যেতাম, গ্রন্থ বিতরণ করতাম। সেখানে গৌর আরতিও করতাম। নৃত্য কীর্তনের সময় উন্মত্তভাবে অথচ নীরবে চতুরাম দাস নামে এক ভক্ত নৃত্য করতেন ।
যদিও কারাগারের মধ্যে অনেক বছর কাটানোর প্রস্তুতি ইতোমধ্যে নিয়েছিলাম। কিন্তু এসবের মাঝে আমরা অত্যন্ত সুখী ছিলাম এজন্যই যে, আমরা ভক্তদের সঙ্গে কথা বলতে পারতাম আর উচ্চস্বরে হরিনাম জপ কীর্তন করতে পারতাম। চেম্বারের মধ্যে যত উচ্চস্বরে সম্ভব গাইতে পারতাম। আমরা যখন রাস্তায় সংকীর্তন করছিলাম তখন এক স্প্যানিশ ছেলেও আমাদের অনুসরণ করেছিল। পুলিশ ভেবেছিল ঐ ছেলেটিও হয়তো আমাদের দলে এবং তাই তাকেও তারা গ্রেপ্তার করেছিল। যখন আমরা কারাগারে আসি সে বলল, “আমাকে গ্রেপ্তারের কারণ, আমি একজন নাস্তিক ছিলাম তাই।” কিন্তু কারাগারে আসার ১৪-১৮ দিন পর সে পুরোপুরি ভক্ত হয়ে যায়। একসময় সে জিজ্ঞেস করল সে কিভাবে দীক্ষা পেতে পারে? এটি ভক্তসঙ্গের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যদিও পরিস্থিতিটি ভক্ত হওয়ার অনুকূল ছিল না। আবার প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে তার অন্য কোনো উপায়ও ছিল না। একটি ডাবল প্রিজন সেলে নয়জন উৎসাহী ব্রহ্মচারীর সান্নিধ্য লাভ করার ফলে সে ভক্তে পরিণত হয়।
তার পিতা ছিল বার্সেলোনার একজন সিনিয়র জজ। তার পুত্র বাড়ি না ফেরাতে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন এবং বিভিন্ন বৈধ অবৈধ পন্থায় তিনি অবশেষে তার পুত্রকে খুঁজে পেয়েছিলেন। যখন তিনি দেখলেন তার পুত্র কারাগারের ভিতর তখন তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। একসময় তিনি বলেন, “কয়েকদিনের মধ্যেই তুমি ছাড়া পেয়ে যাবে।” কিন্তু পুত্রটি বলল, “আমি আমার বন্ধুদের ছাড়া কারাগার থেকে বের হব না।” তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন “তোমার বন্ধুদের নাম কি?” পুত্রটি বলল, “ইন্দ্ৰদ্যুম্ন, প্রকাশানন্দ, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, বিমলসহ আরও কয়েকজন।”
অবশেষে আমাদেরকে পুলিশ কারাগার থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য করা হল। কিন্তু যেহেতু এখানে বাধ্য করা হল, তারাও মুক্তি দিতে চাইছিল না। এজন্যে আমাদের কিছুটা লড়াই করতে হয়েছিল। তারা আমাদেরকে শহরের বাইরে নিয়ে গেল । শুধু গামছা পরিহিত অবস্থায় অসহনীয় এবং বিপজ্জনক ঠাণ্ডার মধ্যে নয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কোনো এক স্থানে নিয়ে গেল দিনটি খুব কুয়াশাচ্ছন্ন ছিল। সেখানে আমাদেরকে ছেড়ে দেওয়ার পর যে কোনোভাবে হোক প্যারিসে যাওয়ার টিকিট কেনার জন্য অর্থ জোগাড় করলাম। যদিও এমনকি আমাদেরকে মুক্ত করার পরও তারা খারাপ ব্যবহার করেছিল। কিন্তু তবুও আমি সেই মুহূর্তটির কথা ভুলব না যখন গার্ড তার চাবিগুচ্ছ নিয়ে এসে শব্দ করে দরজা খুলে বলল “সকলেই মুক্ত”। আমরা সেই বিশেষ মুহূর্তটি এভাবে তুলনা করতে পারি যে, জড় জগতের সাধারণ একটি কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর ভক্তরা যেভাবে পুলিশের গাড়িতে করে সেই স্থানে আসার আগ পর্যন্ত উৎফুল্লতার সাথে নৃত্য করতে লাগল, ঠিক সেরকম প্রফুল্লতার অভিজ্ঞতা আমরা এই জড় জগৎ থেকে মুক্ত হওয়ার পর লাভ করতে পারি। বরং সেই আনন্দ এই আনন্দের চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি। কেননা জীব শুধু জড় বদ্ধ দশা থেকেই মুক্ত হয়নি বরং সমস্ত জড় দুঃখ-দুর্দশা যেমন জন্ম-মৃত্যু-জড়া-ব্যাধি থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়েছে। তাই তখন আমাদের আনন্দের সীমা কিরকম হতে পারে তা বলাই বাহুল্য।