এই পোস্টটি 1838 বার দেখা হয়েছে
আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য
কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ
১৯৭৬ সালের ২ মে লাউটোকা, ফিজিতে শ্রী শ্রী কালীয় কৃষ্ণ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে প্রদত্ত প্রবচন
ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহোদয়াগণ,আপনাদের এই সুন্দর দেশটিতে আজ এক শুভ দিন, কেননা আজ আমরা এখানে কালীয় কৃষ্ণের মন্দির প্রতিষ্ঠা করছি।অবশ্যই এখানে শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ ও গুরু গৌরাঙ্গের বিগ্রহ সমূহও থাকবে।আর এ ব্যাপারে আপনাদের উৎসাহজনক সঙ্গদানের জন্য আমি আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই।
শ্রীবিগ্রহারাধন-নিত্য-নানা-
শৃঙ্গার তন্মদিরমার্জনাদৌ।
যুক্তশ্চ ভক্তাংশ্চ নিযুঞ্জতোহপি
বন্দে গুরোঃ শ্রীচরণারবিন্দম্।।
যিনি শ্রীবিগ্রহের বেশ রচনা ও শ্রীমন্দির মার্জন প্রভৃতি সেবায় স্বয়ং নিযুক্ত থাকেন এবং ভক্তগণকে সেইসব সেবায় নিযুক্ত করেন, তিনি হচ্ছেন গুরু। এছাড়াও গুরুর যোগ্যতা বিষয়ে আরও অনেক কিছু রয়েছে।এই গুরু বন্দনায় আটটি শ্লোক রয়েছে। প্রথম শ্লোকটি হচ্ছে-
সংসার -দাবানল -লীঢ় লোকত্রাণায় কারুণ্যঘনাঘনত্বম।
প্রাপ্তস্য কল্যাণ- গুণার্নবস্য বন্দে গুরোঃ শ্রীচরণারবিন্দম্।।
গুরুদেবের প্রথম কতর্ব্যটি হচ্ছে দাবানল রূপ এই জড় জগৎ হতে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের উদ্ধার করা। এই জড় জগৎকে দাবনলের সাথে তুলনা করা হয়েছে। দাবানল কি সেটা আপনারা জানেন। বনে মাঝে মাঝে আগুন লাগে। বড় বড় বন, সেখানে কেউ আগুন লাগাতে যায় না। কিন্তু আপনা থেকেই সেখানে আগুন লাগে।তাই এই জড় জগৎকে দাবানলের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এখানে,এই জড় জগতে সবাই সুখী হতে চায়, কিন্তু আগুন রয়েছে এমনকি আমরা না চাইলেও দুঃখদুর্দশরূপ সেই আগুন রয়েছে। কেননা এই স্থানটি এই জড় জগৎ হচ্ছে দুর্দশা ভোগ করার জায়গা।ভগবদগীতায় স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ দ্বারা তা প্রতিপন্নিত হয়েছে, দুঃখালয়ম্ অশাশ্বতম্। এই জগৎ হচ্ছে দুঃখের আলয় । কিন্তু মায়ার বন্ধন জনিত কারণে আমরা সেগুলিকে সুখ বা আনন্দ উপভোগ রুপে গ্রহণ করছি। একেই বলে মায়া। প্রকৃতপক্ষে এখানে কোনো স্থায়ী নির্মল আনন্দ নেই। কোথায় আনন্দ? আমাদের যখন মরেই যেতেই হয়, তখন সেই আনন্দের প্রশ্নটি কোথায়? কেউ সুস্থ জ্ঞানে মরতে চাই না। যদি কখনও কোনো বিপদ ঘটে,তৎক্ষনাৎ আমরা পালিয়ে যাব। তার কারণ হল কেউই মরতে চায় না। তাই ভগবদগীতায় ভগবান দুঃখের চারটি সূত্রের বর্ণনা করেছেন- জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধি দুঃখদশানুদর্শনম । যারা বুদ্ধিমান তারা এই চারটি সূত্রকে প্রধান দুর্দশারূপে গ্রহণ করে। সেটি কি? জন্মগ্রহণ করা, মৃত্যু , ব্যাধি হতে দুর্দশা ভোগ করা এবং বৃদ্ধ হওয়া। তাই যত দীর্ঘ সময় ধরে আপনি এই জড় শরীরটি লাভ করবেন, আপনাকে তত দুর্দশা ভোগ করতে হবে। এখন মায়ার বন্ধের অধীনে আপনি এই দুর্ভোগকে আনন্দ রুপে গ্রহণ করতে পারেন। সেটি আপনার ব্যাপার। কিন্তু এটি হচ্ছে দুর্দশাভোগ।
তাই গুরুদেবের কর্তব্য হচ্ছে দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা থেকে শিষ্যকে উদ্ধার করা। সংসার-দাবানল-লীড় লোকত্রাণায় কারুণ্যঘনাঘনত্বম ।পরমেশ্বর ভগবানের যিনি কৃপা প্রাপ্ত হয়েছেন, তিনি গুরুর মাধ্যমে উদ্ধার প্রাপ্ত হতে পারেন।
অন্য আরও কর্তব্যের মতো গুরুদেবের একটি কর্তব্য হচ্ছে নিয়মিতভাবে পরমেশ্বর ভগবানের শ্রীবিগ্রহের আরাধনার জন্য মন্দির প্রতিষ্ঠা করা। খুব সুন্দরভাবে আরাধনা করার জন্য শ্রীবিগ্রহকে সাজানো, মন্দির মার্জন, আহার্যদ্রব্য ভগবানকে নিবেদন, প্রসাদ বিতরণ এ সবই হচ্ছে মন্দিরের কার্যক্রম। দুর্ভাগ্যবশত মানুষেরা এতটাই অজ্ঞ যে, তারা এখন সবকিছু ভুলে গিয়ে কুকুর-বিড়ালের মতো জীবন যাপন করছে। তাই আপনাদের কাছে এটি একটি মহৎ সুযোগ যে, আপনারা এখানে একটি সুন্দর মন্দির উদ্বোধন করতে চলেছেন।
মহাপ্রভোঃ কীর্তন-নৃত্য-গীত
বাদিত্রমাদ্যন্মনসো রসেন।
রোমাঞ্চ-কম্পাশ্রু-তরঙ্গভাজো বন্দে গুরোঃ শ্রীচরণারবিন্দম্।।
এই সমস্ত সুযোগ লাভ হয়েছে আমাদের শ্রী পুঞ্জা ও তার স্ত্রী ভগবতী ও তাঁর মাতার উদ্যোগ দ্বারা। এখন থেকে শ্রীপুঞ্জা বাসুদেব দাস নামে পরিচিত হবেন। যেহেতু আমাকে সারা পৃথিবী পর্যটন করতে হয় তাই আপনাদের সঙ্গে এখানে ঘন ঘন দেখা হওয়া হয়ত সম্ভব হবে না। কিন্তু আমি এখানে পুনরায় আগমনের আশা রাখছি। কিন্তু এখন সমস্ত কিছুর ভার আমি আপনাদের ওপর দিয়ে গেলাম। যতদূর সম্ভব আমিও সাহায্য করব। মনে রাখবেন আপনাদের সামর্থ্য অনুসারে আপনারা ভগবানের সেবা করতে পারেন। এমন নয় যে,যারা বিগ্রহ অর্চনা করছেন, বিগ্রহকে সাজাচ্ছেন, আরতি করছেন তারা, যারা মন্দির পরিষ্কার করছে তাদের চেয়ে উন্নত স্তরে অবস্থান করছেন। উভয়েই সমান পারমার্থিক জগতে কোনো ভেদাভেদ নেই। এই জগতে যেমন উন্নত স্তর ও নিম্নতর স্তর রুপে কাজের ভেদ রয়েছে,পারমার্থিক জগতে এসব কিছু নেই। সমস্ত কিছুই দিব্য। এভাবে একের পর এক আপনারা সবকিছু হৃদয়ঙ্গম করবেন।
এখন আমার একমাত্র অনুরোধ এই যে, এই মন্দিরের কর্তব্যে আপনারা ঐকান্তিকভাবে অংশগ্রহণ করুন। বিশেষত শ্রবণং কীর্তনং বিষ্ণু শ্রবণং-কীর্তনম্– আমাদের অনেক গ্রন্থ রয়েছে, প্রতিটি গ্রন্থে অসংখ্য পৃষ্ঠা। আপনি যদি কেবলমাত্র এই গ্রন্থগুলি পাঠ করেন এবং শ্রবণ করেন সম্ভবত আপনার সারাজীবন কেটে যাবে। দয়া করে সেটি করুন। কৃষ্ণ সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে, সেই কৃষ্ণকথা শ্রবণ করতে সকলেই আসুন। কৃষ্ণকথা অর্থ হচ্ছে কৃষ্ণ বিষয়ক বিশ্লেষণ বা বর্ণনা। বিশেষত দু ধরনের কৃষ্ণ কথা রয়েছে। একটি হচ্ছে ভগবদগীতা কথা,যে কথা কৃষ্ণ দ্বারা কথিত হয়েছিল।সেটি একটি কৃষ্ণকথা। আরেকটি হচ্ছে শ্রীমদ্ভাগবত।যেখানে কৃষ্ণ সম্বন্ধে বলা হয়েছে। সেটিও কৃষ্ণকথা।অতএব, মন্দির সর্বদা কৃষ্ণকথায়, কৃষ্ণপ্রসাদ বিতরণে পূর্ণ থাকা উচিত। এভাবে আপনার কৃষ্ণচেতনার উন্নতি ঘটিয়ে এই জগতে এবং পরবর্তীতেও আপনি সুখী হউন। এটি আবশ্যক। একান্ত প্রয়োজনীয়। প্রত্যেকেরই কৃষ্ণভাবনাময় হওয়া উচিত। যদি সে তা নয়, তবে সে তার জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে। তাই এই কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনের উদ্দেশ্যেটি হচ্ছে ভেদাভেদহীনভাবে মানব সমাজের সকল সদস্যকে রক্ষা করা। এখানে হিন্দু, মুসলিম,খ্রিষ্টান এই ধরনের কোনো প্রশ্ন নেই। প্রত্যেকেই এই আন্দোলনে যোগদান করতে পারে। এমনকি নিম্ন স্তরের পরিবারে যে জন্মগ্রহণ করেছে,সেও সেটি কৃষ্ণের নির্দেশ
মাং হি পার্থ ব্যপাশ্রিত যেহপি স্যুঃ পাপযোনয়ঃ।
কং পুননব্রর্ক্ষ্মণাঃ পুণ্যা ভক্ত্যা রাজর্ষয়স্তথা।
এমনকি নিম্ন শ্রেণীর পরিবারে জাত লোকদেরও এই কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনে যোগদানের সুবিধা রয়েছে এবং সকলেরই, প্রত্যেক মানুষের তা হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা বা সমর্থতা রয়েছে। তা না হলে পাশ্চাত্য জগতের ছেলেমেয়েরা, যারা বিভিন্ন পরিবার থেকে এসেছে, তারা এই আন্দোলনে যোগদান করল কিভাবে! তারা অত্যন্ত ঐকান্তিকভাবে কৃষ্ণভাবনামৃতকে গ্রহণ করছে। তাই আপনি নিজেও যদি ঐকান্তিক হন এবং এই কৃষ্ণভাবনামৃতের জ্ঞান বিতরণ করেন, তবে এই ফিজি দ্বীপের অধিবাসীরাও কল্যাণ প্রাপ্ত হবে এবং তারাও উদ্ধার পাবে। আমাদের মধ্যে কোনো রকম ভেদাভেদ নেই। কিন্তু সবকিছুই অবশ্যই যথার্থ বিধিনিষেধের অধীন,সঠিক পরিচালনাধীনে সম্পন্ন হতে হবে। সেইসব পালন করার এবং অত্যন্ত সুন্দরভাবে মন্দিরটিকে গড়ে তোলার চেষ্ঠা করুন আর পারমার্থিক আনন্দ উপভোগ করুন। আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।