এই পোস্টটি 488 বার দেখা হয়েছে
গুরুদেবের জন্য উপহার স্বরূপ এক সাধারণ গৃহ থেকে স্বর্ণ প্রাসাদে পরিণত হওয়ার অলৌকিক কাহিনি, যা সারাবিশ্বের জন্য এখনও বিস্ময়কর।
যোগেশ্বর দাস, দ্রাবিড় দাস, জগজ্জীবন দাস
আমেরিকার পশ্চিম ভার্জিনিয়ার অ্যাপালাচিয়ান পাহাড়ে ২০০০ একর জুড়ে উপত্যকা আর বন পরিবেষ্টিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অপূর্ব মনোহর স্থাপনা “প্রভুপাদ প্যালেস অব গোল্ড” বা “প্রভুপাদের স্বর্ণ প্রাসাদ”। সাত বছরের দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর অলৌকিকভাবে হরেকৃষ্ণ ভক্তরা নিজের হাতে এটি তৈরি করে, তা এককথায় অভাবনীয় সাফল্য।
দর্শনার্থীরা যখন এটি পরিদর্শন করে তখন তাদের মনে প্রশ্ন জাগে এটি কিভাবে তৈরি হয়েছে? কারা তৈরি করেছে?
সারাবিশ্ব থেকে লক্ষ লক্ষ পর্যটক আগমন করে প্রতিবছর এই পশ্চিমা বিশ্বের তাজমহল’ দর্শন করার জন্য। এই প্রাসাদটি তৈরি করেছিল ইসকন নব বৃন্দাবনের ভক্তবৃন্দরা। এটি তৈরি করা হয়েছিল ইসকন প্রতিষ্ঠাতা ও আচার্য শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে।
অনেকের ধারণা এই প্রাসাদটি তৈরিতে খরচ হয়েছে ১০ থেকে ১৫ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে এটি তৈরিতে খরচ হয়েছে ৬ লক্ষ ডলার যা শুধু প্রাসাদের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ কিনতে খরচ হয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, ভক্তরা কোনো.. পেশাধারীদের সাহায্য ছাড়াই এটি নির্মাণ করে।
কিভাবে এই অর্থ এসেছে? সাত বছর ধরে নব বৃন্দাবন ফার্ম কমিউনিটির ২০০ জন সদস্য এবং শুভানুধ্যায়ীরা ব্যক্তিগত ডোনেশান সংগ্রহ এবং ট্যুরিজমের মাধ্যমে এ অর্থ সংগ্রহ করে, এতে সনাতনি সম্প্রদায়ের অনেক লোকও তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ।
এই নিউ বৃন্দাবন কমিউনিটির যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৬৮ সালে শ্রীল প্রভুপাদের অন্যতম শিষ্য কীর্তনানন্দের মাধ্যমে।
প্রাসাদটির নির্মাণ কার্য শুরু হয় ১৯৭৩ সালে যা শুধুমাত্র শ্রীল প্রভুপাদের সাধারণ একটি গৃহ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৯৭৭ সালে যখন শ্রীল প্রভুপাদ অপ্রকট হন তখন কীর্তনানন্দ সিদ্ধান্ত নেন এটি শ্রীল প্রভুপাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে গড়ে তোলা হবে। তখন নব বৃন্দাবনের সমস্ত বাসিন্দারা একটি সাধারণ গৃহ থেকে অসাধারণ এক প্রাসাদে পরিণত করেন। ভক্তদের এ বিষয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও তারা এর কাজ শুরু করেন। এক্ষেত্রে কিছু বিজ্ঞ স্থাপত্য শিল্পীদের উপদেশ বা সহায়তা নেওয়া হয়েছিল। তবে এক্ষেত্রে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার তেজোদ্দীপ্ত বাণী তাদের মাঝে কাজ করেছিল,
‘হে কৌন্তেয়! তুমি যা অনুষ্ঠান কর, যা আহার কর, যা হোম কর, যা দান কর এবং যা তপস্যা কর, সেই সমস্তই আমাকে সমর্পণ কর।’ (ভ.গী-৯/২৭)
প্রাসাদ শিল্পীরা
বৃন্দাবন খামার কমিউনিটির নিকটে যদি কাউকে জিজ্ঞেস করা হয়, “কে এই প্রভুপাদ প্রাসাদটি তৈরি করেছে?”
উত্তর আসবে, “হরেকৃষ্ণ ভক্তরা এটি তৈরি করেছে।” যদি ভক্তদের এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয় তারা বলবে, “কীর্তনানন্দ এটি তৈরি করেছিল। আমরা শুধুমাত্র তাকে সাহায্য করেছিলাম।”
যদি কীর্তনানন্দকে জিজ্ঞেস করা হতো, তবে তিনি বলতেন, “ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ভক্তদের মাধ্যমে এটি তৈরি করেছেন।”
কীর্তনানন্দের ভাষ্য : “১৯৭৩ সালে আমরা ডুলাবানাতে একটি কৃষ্ণ মন্দিরের কাজ শুরু করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, এজন্যে বেশ এগিয়েছিলাম। কিন্তু পরে আমি ভাবি যে, এটি খুব একটা যথাযথ নয়। আমরা কৃষ্ণের গৃহ তৈরি করছি, কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমাদের কমিউনিটিতে শ্রীল প্রভুপাদের জন্য কোনো গৃহ নেই। তাই আমি ভাবলাম, শ্রীল প্রভুপাদের জন্য একটি গৃহ তৈরি করা হোক।
কেননা কৃষ্ণের কাছে অগ্রসর হওয়ার এই হল যথাযথ পন্থা। যদি আমরা কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে সেবা নিবেদন করতে চাই, তবে প্রথমে তাঁর ভক্তের উদ্দেশ্যে সেবা নিবেদন করতে হবে। তাই আমরা এটির নির্মাণ কার্য শুরু করেছিলাম। কিন্তু আমরা প্রভুপাদের গৃহ তৈরির পরিকল্পনা করলেও এটি ধীরে ধীরে প্রাসাদের আকার ধারণ করতে শুরু করে। এভাবে একসময় এটি একটি প্রাসাদে রূপান্তরিত হয়।”
ভাগবতানন্দ দাস, যিনি প্রাসাদের বিভিন্ন নকশা ও
ভাষ্কর্য তৈরিতে অবদান রেখেছিলেন। তিনি বলেন, “বৈদিক শাস্ত্রে কৃষ্ণকে বিদগ্ধ হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে। যার অর্থ, যিনি অতিশয় কুশলতার সঙ্গে কলাবিলাস এবং সাজসজ্জা করতে পারেন।” লীলা পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ গ্রন্থে এটি ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, যেহেতু প্রতিটি জীব ভগবানের নিত্য অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেহেতু আমাদের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের গুণাবলী ক্ষুদ্র পরিমাণে রয়েছে।
আমার সামান্য একটু চিত্রশিল্পের গুণ রয়েছে, তবে আমি সেটি ব্যবহার করেছি শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর শুদ্ধভক্তের মহিমা তুলে ধরার উদ্দেশ্যে যেন তাঁরা পূজিত হয়।” ছয় বছর ধরে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন, সুনিপুণভাবে ৩০০ টন পরিমাণের বিশাল গম্বুজ থেকে শুরু করে প্রাসাদের দেওয়ালে এবং স্তম্ভগুলোতে ময়ূর, হস্তীসহ বিবিধ নকশাকার্য সম্পন্ন করেন।
ভাগবতানন্দ ভক্তিমূলক সেবা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্র হিসেবে প্রাসাদটির
গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন, স্থাপত্যশিল্প জনগণ তথা ঐতিহ্যে স্থায়িত্ব এবং বাস্তবতাকে প্রতিফলন করে। প্রাসাদটি ভগবানের শুদ্ধভক্ত শ্রীল প্রভুপাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত একটি স্মৃতিস্তম্ভ। তবে তার চেয়েও বেশি কিছু হল এটি তাঁর শ্রেষ্ঠ কর্মের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। এর মাধ্যমে সারাবিশ্বে যে
কৃষ্ণসংস্কৃতি তিনি স্থাপন করে গেছেন তার একটি প্রমাণ স্বরূপ। এটি দৈনন্দিন উপাসনার এক আদর্শ ক্ষেত্র।
নিত্যদিত দাস নামে এক ভক্ত এই প্রাসাদ নির্মাণ পরিকল্পনার শুরুর দিকে ছিলেন। তিনি প্রাসাদের সিমেন্টের কাজগুলো করেছিলেন। তিনি বলেন, “আমরা যখন
প্রাসাদটির কাজ শুরু করি, তখন এটি মোটেই প্রাসাদের মতো দেখতে মনে হচ্ছিল না। আমাদের পরিকল্পনা ছিল শ্রীল প্রভুপাদের জন্য শুধু একটি আরামপ্রদ আবাস তৈরি করা। কিন্তু প্রোজেক্ট যত অগ্রসর হল, ভক্তরা শ্রীল প্রভুপাদের সন্তুষ্টির জন্য পরিকল্পনা আরো বিস্তৃত করল।”
আমরা উপলব্ধি করেছিলাম, আসলে প্রাসাদটি আমাদেরকে যতটা উন্নত ভক্ত হিসেবে গড়ে তুলছে, আমরা ততটা উন্নতভাবে প্রাসাদটি তৈরি করছি না। তখন কৃষ্ণের প্রতি আমাদের ভক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছিল, শ্রীল প্রভুপাদের জন্য এরকম কিছু একটি অবিস্মরণীয় নিবেদনের প্রয়াসের মাধ্যমে। প্রাসাদটি তৈরির পেছনে সত্যিকারের রহস্য হল, এটি কোনো দলগত কার্য কিংবা যন্ত্রপাতির ভূমিকা নয়, বরং শ্রীল প্রভুপাদের প্রতি ভক্তদের ভালোবাসার শক্তি। যেটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে আমাদের সবাইকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল ।
ওয়াশিংটন ডি.সি. থেকে আগত সনাথ দেবী দাসী প্রাসাদটি নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা ও নকশার কার্য তত্ত্বাবধান করেন। তিনি নিউইয়র্ক সিটির প্রাট ইনস্টিটিউট থেকে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন।
তিনি অফিসিয়াল কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন অনুমোদন নেওয়ার ব্যাপারে সহায়তা করেছিলেন এবং সে সাথে অন্যান্য সেবকদেরকে যেমন যারা মার্বেল লেয়ার নিয়ে কাজ করবে, স্টেইনড্ গ্লাস বসাবে, পাইপ মিস্ত্রি (plumbers), ইলেকট্রিশিয়ান, যারা সিমেন্ট লেয়ারের কাজ করে এবং অন্যান্য আরো অনেককে পরিচালনা করেছিলেন।
তিনি বলেন, “এভাবেই আমি
কৃষ্ণভাবনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম। আমার জীবন একটি সরল উপায়ে গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম, আর্কিটেকচারাল স্কুলে থাকার সময় আমি দেখতাম, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা ইন্দ্রিয়তৃপ্তি ও খ্যাতির বাসনায় লালায়িত। কোনো দালান যেটি তারা তৈরি করে তা কিভাবে লোকেদের চেতনায় প্রভাব ফেলে সে সম্পর্কে কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু এই প্রাসাদটি আধুনিক স্থাপত্য নিদর্শনের মতো নয়, যেখানে সবকিছু রাজকীয় ও জটিল ভাবে নকশাকৃত হবে। যেখানে একটি জানালা হল শুধু দুটি স্তম্ভ ও একটি
লোহার কড়ি (Beam); কিন্তু এতে স্টেইনড্ গ্লাস, খোদাই ভাস্কর্য কর্ম এটিকে বিশেষ কিছুতে রূপান্তর করেছে।
কারণ এটি করা হয়েছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভালোবাসার মাধ্যমে।”
চারুকলার ওপর মিশোরী স্টেট কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করার পর মার্ক মিম্যান একসময় সানফ্রান্সিকোর হরেকৃষ্ণ মন্দিরে আসেন। সেখানে তিনি আবিষ্কার করেন যে, তিনি এখানে আত্ম উপলব্ধি ও শিল্প দক্ষতার প্রয়োগ দুটিই প্রাপ্ত হতে পারবেন। তিনি বলেন, “আমি একবার কৃষ্ণের একটি ছবি এঁকেছিলাম এবং ভক্তরা তা প্রভুপাদকে দেখালেন। তখন তিনি আমাকে দেখতে চাইলেন। যখন আমি তাঁর কক্ষে আসি তিনি বললেন, যেরকম অর্জুন তাঁর যুদ্ধ
করার সক্ষমতা কৃষ্ণসেবার জন্য উৎসর্গ করেছিলেন, ঠিক তেমনি তোমার উচিত তোমার এই চিত্রশিল্পের মেধা ভগবানের সেবার উদ্দেশ্যে নিয়োজিত করা।
শুধু এই মেধাটি নিয়োজিত কর এবং তখন তোমার জীবন হবে মহিমাময়।” তখন মুরলীধর (দীক্ষিত নাম) শ্রীকৃষ্ণের অতীত লীলাবিলাস, তাঁর অবতারগণ এবং ভক্তবৃন্দের অনেক ছবি আঁকেন। শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থ ও ব্যাক টু গডহেড ম্যাগাজিনে তাঁর ছবিগুলো ব্যবহার করা হয়। তিনি এই প্রাসাদের জন্য তাঁর চিত্রকর্মের মেধা ভক্তির সহিত নিয়োজিত করেন। নিউ জার্সি থেকে আগত সুধানু দাস, বিভিন্ন সাজসজ্জায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ভারত থেকে মার্বেল পাথরের ব্যবহার সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করে তিনি এ প্রাসাদের জন্য তা প্রয়োগ করেন। অনেক দর্শনার্থী এসে তার এই সুনিপুণ কার্য দেখে বিস্মিত হন। প্রাসাদটি ঝাড়বাতি (chandelier) দ্বারা সজ্জিত। যার নকশা ও শিল্পের ব্যবহারের জন্য ঈশানী দেবী দাসী (ভার্জিনিয়ার উইলিয়ামস্বার্গ থেকে আগত) উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। তিনি শ্রীশ্রী রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহের অলংকার এবং মুকুটও তৈরি করেছিলেন।
এমনকি শ্রীল প্রভুপাদের মূর্তিও তৈরি করেছিলেন। তিনি এই সৃষ্টি কর্মের জন্য অস্ট্রেলিয়া ও চোকোস্লোভাকিয়া থেকে আমদানিকৃত সুন্দর ক্রিস্টাল ব্যবহার করেন। এ সবকিছুই তিনি পূর্বের কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই করেছিলেন। অবশ্য এ জন্যে ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় ইউরোপীয়ান নকশা সম্পর্কিত গ্রন্থ থেকে ধারণা নিতে হয়েছিল। নির্দেশনা প্রাপ্ত হয়েছিলেন, আমেরিকার সবচেয়ে বড় জুয়েলারি ওয়ার্কশপ পরিদর্শনের মাধ্যমে। সেখান থেকে তিনি ইলেকট্রোপ্লেটিং (ধাতুর প্রলেপ লাগানো) এবং ইলেকট্রোফর্মিং (ধাতুর গঠন পদ্ধতি) এর কৌশল রপ্ত করেছিলেন। এ সৃষ্টিকর্মে অনেক পেশাদারী ব্যক্তি এটিকে তাদের সক্ষমতার উর্ধ্বে বলে ঘোষণা করেন। এই সাফল্যের গোপন রহস্য সম্পর্কে তিনি বলেন, “যদি আপনি জানেন এটি কার
জন্য করছেন, তবে কিভাবে সেরাটি দিতে হবে সে সম্পর্কে আপনি জানবেন। আমার এই কার্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি একটি ভক্তিমূলক নিবেদন, “তাকে সন্তুষ্ট করার একটি প্রচেষ্টা। সর্বোপরি, যদি আপনি সবচেয়ে সুন্দর জিনিসটি তৈরি করতে চান তবে সেটি করা উচিত সবচেয়ে সুন্দর ব্যক্তিটির জন্য।”
নিউ জার্সি থেকে আগত জ্যাক মৌয়েন ছোটবেলা থেকেই নিরামিষাশী ছিলেন। অবশেষে নিউইয়র্কে হরেকৃষ্ণ ভক্তদের
সান্নিধ্যে আসার পর এবং হরে কৃষ্ণ আন্দোলনে যোগদানের পর নাম হয় কশ্যপ দাস। স্বভাবতই প্রাসাদের প্রতি তার সহজাত আকর্ষণ ছিল। তাই তাকে নব বৃন্দাবনের ঘোড়াগুলোর দেখাশোনার জন্য নিয়োজিত করা হয়। তিনি ১৯৭৪ সালে ঘোড়াগুলোকে ভূমি প্রস্তুত ও গাছের গুড়ি সরানোসহ বিভিন্ন কার্যে নিয়োজিত করেন। অনেক সময় ডিনামাইট, বুলডোজার ইত্যাদি ব্যবহার করে আঠারো ঘণ্টা
বা তারও বেশি সময় সেবা করেছিলেন। প্রভুপাদের প্রাসাদের জন্য সেবা করতে পেরে তিনি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন।
চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য
মূলত পশ্চিম ভার্জিনিয়া এমনিতেই সুপরিচিত তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং ছবির মতো উঁচু উঁচু পাহাড়
পর্বতের জন্য। সেরকম একটি পরিবেশে অবস্থিত এ প্রাসাদটি। প্রতিটি গম্বুজ এবং সুদৃশ্য কাঁচের রঙিন জানালা দেখে দর্শনার্থীদেরকে একমুহূর্ত হলেও এর সৌন্দর্য সম্পর্কে ভাবতে হবে। হয়তো অবচেতন ভাবে মনে হতে পারে, আমি কি ভুলক্রমে ভারতে অবস্থান করছি? পশ্চিম গ্যালারিতে হাঁটতে হাঁটতে শুরুর দিকেই আপনার চোখে পড়বে সুদৃশ্য রঙিন মার্বেলের তৈরি জানালা যার মধ্যে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে চারদিকে রঙধনুর আভা সৃষ্টি করে। এসব জানালায় রয়েছে কাঁচের প্রাধান্যও। এখানে যে ক্রিস্টালগুলো ব্যবহৃত হয়েছে তা অস্ট্রিয়া থেকে আমদানিকৃত। ভিতরে অনেক কক্ষ রয়েছে যেগুলোর মধ্যে রয়েছে অফিস, সেবকদের কোয়ার্টার এবং রান্নাঘর। প্রাসাদটির সম্মুখে এবং পেছনদিকে ৪টি সুদৃশ্য ময়ূর জানালা বিদ্যমান। যেখানে ১৫০০ পিচেরও বেশি অতি উন্নতমানের কাঁচ ব্যবহার করা হয়েছে। এই প্রাসাদে আরো রয়েছে, প্রভুপাদের
স্টাডি কক্ষ। যেটি উত্তর-পূর্ব গ্যালারিতে অবস্থিত। ঐ কক্ষে প্রভুপাদের অধ্যয়নরত অবস্থায় একটি মূর্তি অবস্থিত। এই কক্ষের দেয়ালগুলোতে বিভিন্ন ধরনের মার্বেল ব্যবহৃত হয়েছে দেয়ালের অলংকারগুলো তৈরি করা হয়েছে খাটি স্বর্ণ দিয়ে। ঐ কক্ষে রাধাকৃষ্ণের অপরূপবিগ্রহ সম্বলিত একটি সুবিশাল বেদী অবস্থিত। যার পাশেই রয়েছে অতি দুর্লভ চায়নিজ ফুলদানী, সম্মুখে দুটি সিংহ মস্তক এবং স্বর্ণের প্লেট মধ্যখানে। সিংহকে
গুরুদেবের ভগবানের বাণী প্রচারের ক্ষেত্রে ভয়হীন গর্জনের সঙ্গে তুলনা করা হয়। দক্ষিণ-পূর্ব গ্যালারিতে রয়েছে শ্রীল প্রভুপাদের শয়ন কক্ষ। এই কক্ষের দেয়ালগুলো বিখ্যাত ইতালিয়ান বটিসিনো মার্বেল দিয়ে তৈরি এবং দেয়ালগুলো দুর্লভ ফরাসিয়ান মনি দ্বারা খচিত। এর সিলিংগুলোতে অঙ্কিত হয়েছে হাজারো ফুলের সমারোহ। এর বাইরেও এখানে সেগুন বৃক্ষের কাঠের ওপর খচিত করা হয়েছে
কৃষ্ণের বিভিন্ন শৈশব লীলার দৃশ্যাবলী। মেঝেতে ব্যবহার করা হয়েছে উজ্জ্বল বাদামী রঙের গ্রীক মার্বেল এবং গাঢ় সবুজ বর্ণের আমদানিকৃত মার্বেল। বেডরুম, বাথরুম ও ড্রেসিং রুম প্রায় পরপরই রয়েছে। এখানে এক একটি বেসিনে তিনশ পাউন্ড ওজনের ধূসর কমলা রঙের মার্বেল ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে যে পাইপার নলসমূহ রয়েছে তা ২২ ক্যারেট স্বর্ণ দিয়ে তৈরি।
বেসিনের ওপরে যে সুদৃশ্য আয়নাটি রয়েছে তা অষ্টাদশ শতাব্দির স্প্যানিশ আয়না। প্রভুপাদের এই প্রাসাদটিতে ১৭টি দেশের সর্বসাকুল্যে ৫২ ধরনের মার্বেল ব্যবহার করা হয়েছে। ২৫৪ টনেরও বেশী ওজনের এই মার্বেল পাথরগুলো প্রায় ৩৫,০০০ ফুট পর্যন্ত বিস্তৃত। শুধুমাত্র দেয়াল এবং মেঝের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে
৫০ ধরনের বিভিন্ন আকৃতির মার্বেল এবং যে মনিগুলো দ্বারা এগুলো খচিত সেগুলো আমদানী হয়েছে ফ্রান্স, ইতালি, কানাডা এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে। এগুলোকে বিভক্ত করা হয়েছে প্রায় বিশ হাজারেরও বেশি খণ্ডে এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন আকৃতির সুদৃশ্য ডিজাইনে রূপ দেয়া হয়েছে। এখানে যে মন্দির কক্ষটি রয়েছে তার পিলারগুলো তৈরি মার্বেল দিয়েই এবং অনন্য ডিজাইনসমূহ ভারতীয় বিভিন্ন বিখ্যাত মন্দির এবং ইউরোপিয়ান সম্ভ্রান্ত গৃহের আঙ্গিকেই তৈরি। দক্ষিণের প্রবেশপথে অনেকগুলো
সেগুন কাঠের দরজা রয়েছে যেগুলোতে হাতি, পদ্ম এবং অতি মনোরম বিভিন্ন পুস্প দ্বারা খচিত। এখানে প্রতিটি দরজার ওপরে বিভিন্ন কারুকাজ রয়েছে যার প্রতিটি পরতে পরতে রয়েছে খাঁটি স্বর্ণের ব্যবহার। এই কারুকাজগুলোতে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের পাতা রয়েছে যা ৮,০০০ ফুট পর্যন্ত বিস্তৃত। অনেক মেঝেতে বিভিন্ন রঙের পাকিস্তানি মণি ব্যবহার করা হয়েছে। গম্বুজগুলোতে খোদাইকৃত রয়েছে শ্রীকৃষ্ণ এবং
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বিভিন্ন লীলা। শ্রীল প্রভুপাদের স্বর্ণের ব্যাসাসনও প্রতিটি দর্শনার্থীর মন কেড়ে নেয়। শুধু তাই নয় এই কক্ষে ২,০০০ এরও বেশি মার্বেল ও মণি টুকরো এবং ৪,০০০ এরও বেশি খণ্ড খণ্ড ক্রিস্টালের ব্যবহার চোখ জুড়িয়ে যায়। তাছাড়া এর চারপাশে বিস্তৃত যত ধরনের গোলাপ ফুলের বাগান রয়েছে তা গোটা আমেরিকার জন্যও দুর্লভ সৃষ্টিকর্ম। কেননা এখানে অনেক দুর্লভ গোলাপ ফুল
দেখতে পাওয়া যায়। হাজার হাজার রঙ বেরঙের ফুলে সজ্জিত এর চারপাশ দেখে মনে হয় এ যেন স্বয়ং গোলক বৃন্দাবন। এখানে শ্রীল প্রভুপাদের যে সমাধিস্থল রয়েছে তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা শ্রীল প্রভুপাদ এক সময় বলেছিলেন, “আমি ইতোমধ্যেই এখানে অবস্থান করছি এবং সর্বদা অবস্থান করব।”
“এটি স্বর্গের মত দেখতে”
এক স্থানীয় সাংবাদিক এই প্রাসাদ সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, “আপনি বিশ্বাস করবেন না এটি পশ্চিম ভার্জিনিয়াতে রয়েছে,” “আপনি বিশ্বাস করবেন না এটি আমেরিকাতে রয়েছে।”
এক পরিদর্শকের মন্তব্য ছিল, “আমি জীবনে এমন সুন্দর স্থান দেখিনি, মনে হয় স্বর্গ এরকমই।” হুইলিং নিউজ রেজিস্টারের মন্তব্য “স্বর্ণ, রৌপ্য, মার্বেল, অনিক্স, স্টেইনড্ গ্লাস এবং সেগুনকাঠ এর সমন্বয়ে একটি প্রাসাদ। ইউরোপীয়ান শ্রেষ্ঠদের আঙ্গিকে এই প্রাসাদের সিলিংগুলো হাতে অংকন করা হয়েছে। এটি এমন একটি প্রাসাদ যা তৈরিতে ৬ বছর লেগেছে। প্রভুপাদের প্রাসাদ, নব বৃন্দাবনের হরে কৃষ্ণ কমিউনিটিতে.. নিউইয়র্ক টাইমস্রে মন্তব্য, ‘কালো আর সোনালী গম্বুজময় প্রাসাদে অপূর্ব ঐশ্বর্য বিদ্যমান যা অনেক পরিদর্শকদের বিস্মিত করেছে। এটিতে রয়েছে ইটালিয়ান মার্বেল মেঝে, দেওয়ালগুলোতে ব্যবহৃত হয়েছে ইরানি অনিক্স, স্তম্ভগুলোতে স্বর্ণের পাতা, স্টেইনড্ গ্লাস জানালাগুলোতে ময়ূর নকশা, অনেক ক্রিস্টাল ঝাড়বাতি….এ সবকিছু অবস্থিত মাইলের পর মাইল পাহাড়, বন আর চতুর্দিকে খামারভূমি দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে।” নিউইয়র্ক টাইমস্ এই স্বর্ণ প্রাসাদকে ‘আমেরিকার তাজমহল’ হিসেবে ঘোষণা করে। ওয়াশিংটন পোস্টের মন্তব্য, “প্রায় স্বর্গ”। পি.এম. ম্যাগাজিনের মন্তব্য, “প্রাসাদটি অভূতপূর্ব কর্ম”। এবিসি ওয়ার্ল্ড অব পিপল এর মন্তব্য, “এটি বিশ্বাস করার জন্য আপনাকে এটি দেখতেই হবে।” ওহিও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব আর্কিটেকচারের অধ্যাপক জর্জ ক্লার্ক বলেন, দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও তথ্যমূলক ট্যুরিস্ট আকর্ষণে পরিণত হয়েছে।” “এটি পিটসবার্গ প্রেস নোটে বলা হয়, “প্রভুপাদ প্রাসাদটি সম্পূর্ণরূপে কৃষ্ণভক্তদের দ্বারা তৈরিকৃত, যাদের অধিকাংশই প্রোজেক্ট শুরুর পূর্বে এ বিষয়ে অদক্ষ ছিল।” ‘সরল জীবন, উচ্চ চিন্তা’ এই আদর্শের ওপর ভিত্তি করে ভক্তদের জীবন প্রতিষ্ঠিত, আর এভাবে শ্রীল প্রভুপাদের প্রতি তাঁর ভক্তবৃন্দ কর্তৃক নিবেদিত এই অনুপম প্রাসাদ ‘প্রভুপাদ প্যালেস অব গোল্ড’ বা ‘প্রভুপাদের স্বর্ণ প্রাসাদ’।