এই পোস্টটি 175 বার দেখা হয়েছে
জাগতিক বিষয়ের প্রতি আসক্তি পারমার্থিক জীবনকে বিপন্ন করতে পারে
যুগাবতার দাস
একটি হরিণ চোখের দর্শনের জন্য মোহনীয় হতে পারে। যেভাবে এটি বিচরণ করে, ছুটোছুটি করে ও খেলাধূলা করে তা অনেকের জন্যই দর্শনীয় হতে পারে। হরিণ সম্পর্কে বিভিন্ন কাহিনিও রামায়ণসহ শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণিত আছে। নিম্নে সে সমস্ত কাহিনি তুলে ধরা হলো।
মাতা সীতা ও হরিণ
মাতা সীতা একটি মায়াহরিণের রূপে আকৃষ্ট হন। মারিচ নামে এক অসুর সুন্দর মায়াবী হরিণের ছদ্মবেশ ধারণ করে সীতাদেবীর কুড়েঘরের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছিল। হরিণটি খেলার ছলে সীতাদেবীর নিকটে এসে আবার দৌড়ে চলে যায়। সীতাদেবী সেই হরিণকে দর্শন করে মোহিত হয়ে রাম ও লক্ষ্মণকে হরিণটি দর্শন করার জন্য ডাকে। লক্ষণ হরিণটিকে দেখে সন্দেহ করেন এবং সতর্ক করেন যে, এই প্রাণীটি হরিণ নয় বরং একটি অসুর। কিন্তু হরিণের প্রতি মোহিত সীতাদেবী রামকে পাঠালেন সেই হরিণটিকে ধরার জন্য এবং এর পরে রামকে সাহায্য করার জন্য লক্ষণকে অনুরোধ করলেন। যখন লক্ষ্মণ তাকে একা ছেড়ে চলে যেতে অসম্মতি জানালে সীতাদেবী এমনকি তার অন্যরকম মানসিকতা রয়েছে বলে লক্ষণকে ভর্ৎসনা করেন।
এই লীলাবিলাসের মাধ্যমে মাতা সীতা আমাদেরকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রদান করেছেন। যা হলো কিভাবে একটি মোহিত আত্মা ধীরে ধীরে পতিত হয়। আত্মা মায়ার দ্বারা প্রভাবিত হয়। আক্ষরিক অর্থে মায়া মানে হলো ‘যা নয়’। এটি ঠিক সেই হরিণটির মতো, যেটি আসলে হরিণ ছিল না বরং একটি অসুর ছিল।
লক্ষণ হলেন পরম গুরুদেব শ্রীবলদেবের স্বরূপ। সেই গুরুদেব আমাদের এই প্রকার ইন্দ্রিয়ের বিষয় সম্পর্কে সতর্ক করেছেন, কিন্তু আমরা ইন্দ্রিয়ের বিষয়ের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তির ফলে তাঁর সেই নির্দেশ অনুসরণ করতে ব্যর্থ হই। আমরা বিভিন্ন আকর্ষনীয় বিষয়ের প্রতি এত আসক্ত হয়ে ভগবানের কাছে দাবি করি, যেন তিনি আমাদের বাসনাগুলো অবশ্যই পূর্ণ করেন। ফলে আমরা পরমেশ্বর ভগবান ও পারমার্থিক গুরুদেবের আশ্রয় থেকে বঞ্চিত হই। কেননা কামের প্রতিমূর্তি রাবণ আমাদের অপহরণ করে। এভাবে আমরা ভক্তসঙ্গ বিবর্জিত একটি জনশূন্য স্থানে পতিত হই। শ্রীরাম ও গুরুদেবের নির্দেশ থেকে সামান্য বিচ্যুতির মাধ্যমে সামান্য একটি বিষয়রূপ হরিণের প্রতি মোহিত হওয়ার ফলে আমরা অপহৃত হই। ভক্তিমূলক সেবার ক্ষেত্রে সামান্য অবহেলা বা অমনোযোগীতা আমাদেরকে মারাত্মক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে।
ভরত মহারাজ
ভরত মহারাজ দৃঢ়তার সহিত ভক্তিমূলক সেবা নির্বাহ করার জন্য তাঁর স্বর্ণপ্রাসাদ পর্যন্ত পরিত্যাগ করেছিলেন। তিনি বনে গমন করেছিলেন। একদিন তিনি করুণাবশত একটি আশ্রয়হীন ছোট শিশু হিরণকে তার আশ্রমে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই হরিণটির প্রতি তিনি এত আসক্ত হয়ে পড়েন যে একসময়, ভক্তিমূলক সেবা পর্যন্ত পরিত্যাগ করেছিলেন।
পরমেশ্বর ভগবান সমস্ত জীবের পরম আশ্রয় ও পালনকর্তা। কিন্তু মায়ার বশবর্তী হয়ে আমরা ভাবি, আমাদের প্রতিপালক আমরাই। আমরা সেগুলোকে আমাদের সম্পত্তি দাবি করে অত্যধিক আসক্ত হয়ে পড়ি। এই প্রকার আসক্তির ফলেই ভরত মহারাজ ঐ জীবনে ভগবদ্ধামে প্রত্যাবর্তনে ব্যর্থ হয়। যদি আমাদের গৃহ ও পরিবারের প্রতি এখনো আসক্তি বর্তমান থাকে তবে ভগবান কেন তার গৃহের দ্বার আমাদের জন্য উন্মুক্ত করবেন? এর মানে এই নয় যে, আমাদের নিকটস্থ আপন জনদের প্রতি নিরাসক্ত হওয়া উচিত? বরং ইতিবাচকভাবে এই মনোভাব নিয়ে তাদের প্রতি আসক্ত হওয়া উচিত, তারা হলেন কৃষ্ণের সম্পত্তি এবং কৃষ্ণই তাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং তাদের জন্য কৃষ্ণের যথাযথ পরিকল্পনাও রয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় হলো তাদেরকে কৃষ্ণকথা ও আমাদের জীবনে তার প্রেমময়ী নিয়ন্ত্রণের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া।
মহারাজ দশরথ
রাজা দশরথের জীবনেও একটি হরিণ দূর্ভাগ্যের সৃষ্টি করেছিল। একসময় তিনি যখন শিকারের জন্য বনে গমন করেন তখন তিনি দূর থেকে জল আন্দোলনের শব্দ শ্রবণ করে তিনি ভাবলেন, বোধহয় কোনো হরিণ জলাশয় থেকে জলপান করছে। দূর্ভাগ্যবশত তিনি সেই দিকে তীর নিক্ষেপ করলে দেখেন এটি একটি হরিণ ছিল না বরং একজন যুবক ব্যক্তি ছিলেন। তার নাম হল শ্রবণ কুমার এবং তিনি ছিলেন তার অন্ধ পিতা-মাতার একমাত্র পুত্র। ফলশ্রুতিতে শোকাহত পিতা-মাতা তখন মহারাজ দশরথকে অভিশাপ দিলেন যে, তিনি তার পুত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার শোকে কাতর হয়ে মৃত্যুবরণ করবেন। অনেক বছর পর যখন ভগবান রামচন্দ্র বনবাসে গমণ করলেন তখন রাজা দশরথ তার পুত্র রামের বিরহে কাতর হয়ে দেহত্যাগ করেন। একটু কল্পনা করুন, কিভাবে হরিণের জল পানের এক মোহময় শব্দ এক ধার্মিক রাজার জীবনে দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে আসে।
মুখোশ হরিণ (কস্তুরী হরিণ)
মুখোশ হরিণ তার নিজের দুর্দশার জন্যই দায়ী। তার শরীর থেকে এমন এক সুগন্ধ নিঃসরণ হয় যে সে বুঝতেই পারে না যে, এটি তার নিজের শরীর থেকেই আসছে কিন্তু সে অদ্ভূত সেই সুগন্ধের অনুসন্ধানে দৌড়তে থাকে। এভাবে সে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে থাকে। অতঃপর অতিরিক্ত দৌড়ের ফলে সে পরিশ্রান্ত হয়ে প্রাণ ত্যাগ করে। জীব স্বভাবতই সচ্চিদানন্দ প্রকৃতির, যে সুখের সুগন্ধ নিঃসরণ করে থাকে। কিন্তু মোহবশত বদ্ধ জীব সেই আভ্যন্তরীন পারমার্থিক সুখের সুগন্ধকে অগ্রাহ্য করে বাহ্যিক সুখের প্রতি ধাবিত হতে থাকে। হৃদয়ের আভ্যন্তরীন সম্পদ আবিষ্কারে ব্যর্থ হয়ে বাহ্যিক আনন্দের ব্যর্থ অনুসন্ধানের মাধ্যমে পরিশ্রান্ত হতে হতে একসময় প্রাণ ত্যাগ করে।
হরিণ ও শিকারী
একজন দক্ষ শিকারী তার বাঁশিতে সুমধুর সুরে হরিণকে আকৃষ্ট করে। হরিণ তখন ভাবাবিষ্ট ও হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঐ অবস্থায় শিকারী হরিণটিকে সহজেই আটকে ফেলে ।
ঠিক তদ্রুপ বদ্ধ জীবেদেরও জাগতিক শব্দ তরঙ্গ (যেমন ছায়াছবির অশ্লীল/উত্তেজক গান, বাজনা) শ্রবণের প্রবণতা রয়েছে। এই শব্দ তরঙ্গ জীবেদের এমন মোহগ্রস্থ করে যে, মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সে জীবের পরম ও একমাত্র সুহৃদ মুক্তিদাতা মুকুন্দকে ভুলে থাকে এবং অবশেষে মৃত্যুদেবতা সেই পাপী আত্মাকে টেনে হিচঁড়ে নরকে নিয়ে দুঃসহনীয় যমযাতনা দেয়।
পক্ষান্তরে যদি বদ্ধ জীব ভগবানের পবিত্র নাম সতর্কতার সহিত শ্রবণ করে, তখন ভগবান যিনি সর্বদা নিবেদিত আত্মাদের শিকার করে থাকেন তিনি ভক্তের জন্য তার বাঁশি বাজাতে থাকেন। সেই বাঁশির শব্দ আমাদের হৃদয়কে মোহিত করে ভক্তির আবৃত মুখোশকে অনাবৃত করে। তখন বদ্ধ জীব সর্বপ্রকারের হরিণের প্রতি আসক্তি ত্যাগ করে এবং প্রার্থণা করে, “হে আমার প্রিয় ভগবান, আমি সত্যিই আপনাকে দর্শন করতে চাই, আমি আপনার সঙ্গে থাকতে চাই, আপনার সেবা করতে চাই ।”
লেখক পরিচিতি : যুগাবতার দাস মুম্বাইয়ের কেইএম হাসপাতালের এ্যানাটমি বিভাগের একজন প্রফেসর হিসেবে কর্মরত আছেন এবং তিনি নিয়মিত BTG’র সেবা করছেন।