এই পোস্টটি 253 বার দেখা হয়েছে
আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের (ইসকন) প্রতিষ্ঠাতা-আচার্য
কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ স্বামী প্রভুপাদ
১৯৭৫-এর চিকাগোতে এক প্রাতঃভ্রমণের সময় জনৈক ছাত্রের সঙ্গে এই কথোপকথনটি হয়েছিল
ছাত্র: ইতোপূর্বে আপনি বলছিলেন যে, পাশ্চাত্য জগৎ পারমার্থিক দিক দিয়ে অন্ধ এবং ভারতবর্ষ প্রযুক্তিবিদ্যার দিক থেকে খোঁড়া, কিন্তু তারা যদি তাদের সম্পদ একত্রিত করে, তা হলে ভারত এবং পাশ্চাত্য উভয়ই উপকৃত হবে।
শ্রীল প্রভুপাদ: হ্যাঁ, যদি অন্ধলোকসদৃশ পাশ্চাত্য জগৎ, খোঁড়ালোকসদৃশ ভারতবর্ষকে কাঁধে চড়ায়, তা হলে খোঁড়ালোকটি পারমার্থিক পথ দেখাতে পারে এবং অন্ধলোকটি জড় জাগতিকভাবে প্রযুক্তিবিদ্যার মাধ্যমে তাদেরকে পুষ্টিসাধন করতে পারে। যদি আমেরিকান এবং ভারতবাসী উভয়েই যৌথভাবে তাদের প্রযুক্তি বিদ্যা এবং পারমার্থিক সম্পদ পরস্পর উপভোগ করে, তা হলে এই সংযোগের ফলে সমগ্র বিশ্বে যথার্থ শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরে আসবে।
এই আমেরিকানরা কত বড় অন্ধ। তারা মানব জীবন লাভ করেছে এমন বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন জীবন, কিন্তু তথাপিও তারা এই জীবনটি ব্যবহার করছে সরোবরে মোটর বোটে চড়ে বেড়াবার জন্য। তোমরাই দেখ? একজন মানুষের প্রতিটি মুহূর্ত ব্যবহার করা উচিত তার কৃষ্ণচেতনা পুনরুদ্ধারের জন্য। এক মুহূর্তও নষ্ট করা উচিত নয়- আর এই লোকগুলি নতুন নতুন পন্থা বের করছে শুধুমাত্র সময় নষ্ট করার জন্য।
নিঃসন্দেহে, আমেরিকানরা সব কাজগুলি করছে উন্নত প্রযুক্তিবিদ্যার মাধ্যমে, কিন্তু তারা সব কিছু করছে ‘অন্ধ’ বা যুক্তিহীন ভাবে। তুমি হয়তো একজন খুব ভাল চালক, কিন্তু যদি তুমি অন্ধ হও, তা হলে তুমি কিভাবে ভাল করে গাড়ি চালাবে? বরং তুমি দুর্ঘটনার সৃষ্টি করবে। সুতরাং আমেরিকার লোকদের অবশ্যই পারমার্থিক দিকে থেকে তাদের চক্ষুকে উন্মুক্ত করতে হবে, তবেই তাদের সুন্দরভাবে গাড়ি চালাবার দক্ষতা ঠিকভাবে প্রয়োগ হবে। এখন তারা অনুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে দেখতে চেষ্টা করছে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের চিন্ময় স্বরূপের প্রতি অন্ধ হয়ে থাকবে, তারা কি তাদের প্রকৃত স্বরূপ দেখতে পাবে? তাদের হয়তো অণুবীক্ষণ যন্ত্র থাকতে পারে-কিন্তু তবুও তারা হচ্ছে অন্ধ। সেটা তারা জানে না।
ছাত্র: আমার মনে হয় অধিকাংশ আমেরিকানরা আত্মোপলব্ধি থেকে, একটি পরিবারের উন্নতিসাধনের দিকে বেশি আগ্রহান্বিত ।
শ্রীল প্রভুপাদ: কৃষ্ণভাবনামৃত পারিবারিক জীবনযাত্রার জন্য বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে না। ‘অহৈতুকীপ্ৰতিহতা।’ ভগবৎ ভাবনা কোনো কিছুর দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে না-যদি তুমি আন্তরিক হও। যে কোনো অবস্থাতেই তুমি নিযুক্ত হতে পার। তুমি কৃষ্ণভাবনামৃত চারভাবে সম্পন্ন করতে পার : প্রাণৈরর্থোধিয়া বাচা- জীবনের দ্বারা, অর্থের দ্বারা, বুদ্ধির দ্বারা এবং তোমার বাক্যের দ্বারা। কাজেই তুমি যদি একজন পরিবারের লোক হতে চাও-তুমি যদি প্রতিদিন চব্বিশ ঘণ্টা ভগবানের প্রতি উৎসর্গ করতে না পার- তা হলে অর্থ উপার্জন করে তা কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের জন্য ব্যবহার কর এবং যদি তুমি অর্থ রোজগার করতে না পার, তা হলে তোমার বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগাও। অনেক রকমের বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কাজ আছে। যেমন-গ্রন্থাদি প্রকাশ, গবেষণা করা ইত্যাদি। তুমি যদি তা না পার, তবে তোমার বাক্য প্রয়োগ করে লোকদের কৃষ্ণ সম্বন্ধে বলো। যেখানেই তুমি থাক না কেন, কারোর কাছে শুধুমাত্র ব্যাখ্যা কর যে, “কৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান। আর কৃষ্ণের প্রতি আপনার প্রণতি নিবেদন কর।” ব্যাস্ এইটুকু। তুমি তোমার যে কোনো যোগ্যতা দিয়ে কৃষ্ণের সেবা করতে পার, যদি তুমি তা চাও। কিন্তু তুমি যদি কৃষ্ণকে তোমার সেবায় নিযুক্ত করতে চাও সেটা হবে গুরুতর ভুল।
লোকেরা নিজেরাই তাদের সমস্যাবলী সৃষ্টি করছে। ঈশাবাস্যমিদং সর্বং-ভগবান সব কিছুরই সুব্যবস্থা করেছে। তিনি সব কিছু নির্ভুল ও সম্পূর্ণভাবে সৃষ্টি করেছেন। ‘পূর্ণমিদম্’-কৃষ্ণ সব কিছু পূর্ব থেকেই পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করছেন। কিন্তু নির্বোধেরা সেটা বুঝে না। তারা “সামঞ্জস্য বিধান” করতে চাইছে। সবকিছু আগের থেকেই পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে। শুধুমাত্র লোকেরা এর অসদ্ব্যবহার করছে।।
আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়ায় অনেক জমি আছে এবং প্রকৃতির পর্যাপ্ত খাদ্যশস্যের ওপর আস্থা না রেখে, তারা গবাদি পশু বাড়াচ্ছে তাদেরকে হত্যা করার জন্য। এই হচ্ছে তাদের বুদ্ধি। লোকেরা এখন উৎপাদন করছে কফি, চা ও তামাক, এমনকি যদিও তারা ভালোভাবে জানে এই জিনিসগুলি তাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক। পৃথিবীর কোনো কোনো অংশে খাদ্যাভাবে লোক মরছে এবং তথাপি পৃথিবীর অন্য অংশের লোকেরা তামাক উৎপাদন করছে, যা শুধু রোগ ও মৃত্যুকে ডেকে আনবে এরকমই হচ্ছে তাদের বুদ্ধিমত্তা।
সমস্যা হচ্ছে, এই অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন লোকগুলি জানে না যে, “জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবানকে জানা।” লোকেরা মনে করে তারা উন্নত হয়েছে কারণ তারা গাড়ির সাহায্যে দৌড়াতে পারে। তারা মনে করে তারা সভ্য হয়েছে, কিন্তু তাদের কাজ হচ্ছে দৌড়ানো, সেটুক পর্যন্তই।
ছাত্র: দৌড়ানোর উদ্দেশ্য একই-আহার, নিদ্রা, মৈথুন ও আত্মরক্ষা করা!
শ্রীল প্রভুপাদ: হ্যাঁ, কিন্তু গাড়ি দ্বারা দৌঁড়ে কি লাভ? তুমি গাড়ি ব্যবহার করতে পার লোকদের কাছে কৃষ্ণের বাণী পৌঁছানোর কাজে। তুমি সব কিছুই কৃষ্ণের জন্য ব্যবহার করতে পার। আমরা কখনো বলি না “এটা ত্যাগ কর।” তুমি যখন ভগবান প্রদত্ত বুদ্ধির দ্বারা কোনো কিছু উৎপাদন করছ, তা ঠিক আছে-যদি তুমি তা ভগবানের জন্য প্রয়োগ কর। কিন্তু যখন তুমি তা কৃষ্ণকে বাদ দিয়ে অন্য উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করছ, তখন সেটা হচ্ছে অর্থহীন।
এই গাড়িটি গ্রহণ করুন খুব সুন্দরভাবে সজ্জিত। যদি আমি বলি, ‘এগুলি সব অর্থহীন”, সেটা কি খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে? না। “যে উদ্দেশ্যে নিয়ে তুমি গাড়িটি নির্মাণ করেছ-সেটাই হচ্ছে অর্থহীন।” সুতরাং আমরা শুধুমাত্র চাইছি লোকদের চেতনার পরিবর্তন করতে। আমরা তাদের উৎপাদিত জিনিসগুলিকে অবজ্ঞা করতে চাইছি না।
যেমন, একটি ছুরি দ্বারা তুমি শাক-সব্জি ও ফল কাটতে পর, কিন্তু তোমার গলা কাটার জন্য যদি তুমি সেটাকে প্রয়োগ কর, সেটাই হচ্ছে বোকামি। সুতরাং এখন লোকেরা আত্মোপলব্ধি, কৃষ্ণভাবনামৃত ভুলে গিয়ে প্রযুক্তিবিদ্যার ছুরি তাদের গলা কাটার জন্য প্রয়োগ করছে। সেটাই হচ্ছে ‘মন্দ।’
নৃদেহমাদ্যং সুদুর্লভং প্লবং সুকল্পং-আমাদের মানব দেহটি হচ্ছে একটি ভালো নৌকার মতো। আমাদের মনুষ্য-বুদ্ধির দ্বারা আমরা অবিদ্যার সমুদ্র- এই জগতে বারংবার জন্ম-মৃত্যুরূপ সমুদ্রকে অতিক্রম করতে পারি। আর গুরুকর্ণধারম্ ময়অনুকুলেন নভস্বতেরিতং পুমান্ ভবাদ্ধিং ন তরেৎ স আত্মাহা-আমাদের আছে একজন দক্ষ কর্ণধার-সদ্গুরু, যিনি আমাদেরকে পরিচালিত করতে পারেন এবং জ্ঞানদান করতে পারেন। এ সব সুবিধা থাকা সত্ত্বেও যদি আমরা অবিদ্যার সমুদ্র পাড়ি দিতে না পারি, তা হলে আমরাই নিজেদের গলা কাটছি। নৌকা রয়েছে, কর্ণধার রয়েছে, অনুকূল বাতাস রয়েছে, কিন্তু আমরা সেগুলিকে কাজে লাগাচ্ছি না। তার অর্থ হচ্ছে আমরা আমাদেরকে হত্যা করছি।
জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৫ ব্যাক টু গডহেড