প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৩ | ৬:৩৪ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০২৩ | ৬:৩৪ পূর্বাহ্ণ

পুরুষোত্তম নিতাই দাস
জুন ২০১৪, মনোবিজ্ঞান’ পত্রিকাতে একটি গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়েছিল তাতে দেখা যায় যে, মানুষ তাঁর প্রয়োজনের তুলনায় অধিক সংগ্রহে বেশী আগ্রহী। মানুষ সংগ্রহের প্রতি কিভাবে প্রলুব্ধ তা প্রমাণ করার জন্য গবেষকরা দুই দফায় পরীক্ষা করেন।
প্রথম দফা : প্রতিযোগীদেরকে কম্পিউটারের সামনে হেডসেট দিয়ে পাঁচ মিনিটের জন্য বসে মধুর সঙ্গীত বা কুৎসিত সংগীত শুনতে পছন্দ করতে বলা হয়েছিল। প্রতিযোগীরা কিছু সময় ধরে কুৎসিত সংঙ্গীত শুনলে ‘চকোলেট’ রোজগার করতে পারবেন। কেউ কেউ প্রত্যেক পিস চকোলেটের জন্য কম কম সময় ধরে শুনল এবং তারা অধিক অধিক উপার্জনক্ষম হলো। আর কেউ অধিক সময় ধরে শুনল এবং কম উপার্জনক্ষম হলো ।
দ্বিতীয় দফা : দ্বিতীয় দফাও পাঁচ মিনিটের জন্য স্থায়ী হয়েছিল। যেখানে প্রত্যেক প্রতিযোগীকে তাদের রোজগারের চকোলেট খেতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তাদেরকে বলা হয়েছিল যে, যদি তারা তাদের রোজগারের চকোলেট খেতে না পারে তাহলে তা বাজেয়াপ্ত করা হবে।উভয় উপার্জনশীল দল মনে করেছিল যে, তারা গড় পাঁচ মিনিটে ৩.৭৫ টি চকোলেট খেতে পারবে। যদিও তারা চকোলেট উপার্জনের সময় তাদের গ্রহণ ক্ষমতা অপেক্ষা অধিক মাত্রায় (১০.৭৪) চকোলেট উপার্জন করেছিল। এটা প্রমাণ করে যে, তারা অধিক উপার্জনের জন্য অধিক সময় ধরে কুৎসিত নোংরা শব্দ শুনতে রাজী ছিল এটা জেনেও যে তাদের অতিরঞ্জিত উপার্জনের চকোলেট তারা গ্রহণ করতে পারবে না। তারা ১০.৭৪ টি চকোলেট রোজগার করেছিল যখন কিনা তাদের গ্রহণ ক্ষমতা ছিল ৩.৭৫ এবং বাকীগুলি তাদের থেকে ফেরত নেওয়া হলো।
বেশী রোজগার এবং কম রোজগারে উভয়েরই এই মানসিকতা দিতে চালিত হয় যে, প্রয়োজনের তুলনায় কত বেশী সংগ্রহ করতে পারবে এবং জমা করতে পারবে। এই প্রাকৃত জগতে তারা চকোলেট নয়, টাকা রোজগার করে এই মানসিকতা দিয়ে।
গবেষক লেখকদের মধ্যে, খ্রীষ্টফার সি, যিনি ব্যাবহারিক বিজ্ঞান এবং বাণিজ্যের অধ্যাপক, যিনি চিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগে ছিলেন, তিনি এটিকে ‘অর্থহীন সংগ্রহ’ আখ্যা দেন।
এই পরীক্ষা এটাই প্রমাণ করে যে, মানুষ অধিক সংগ্রতে বেশী আগ্রহশীল, যেমন টাকা-পয়সা ইত্যাদি যা তার জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনাধিক।
শ্রীল শুকদেব গোস্বামী বলেছেন যে, অর্থ কখনো এক জায়গাতে স্বায়ীভাবে থাকে না। এটি এক হাত থেকে অন্য হাতে হস্তান্তরিত হয়। পরিশেষে কেউই অর্থ ভোগ করতে পারে না এবং এটি যেমন ছিল তেমনি পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সম্পত্তি হিসাবেই থেকে যায়।’
(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/১৪/28)
অধিক সংগ্রহে আগ্রহী মানুষ অসৎ পথ অবলম্বন করে
মানুষ অধিক সংগ্রহের জন্য অসৎ পথ অবলম্বন করতেও দ্বিধা করে না। তারা বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে, যেমন, কর ফাঁকি ইত্যাদ। অধিক ধনবান ব্যক্তিরা ভারতবর্ষে যারা অসদুপায়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করছে তারা সিংহভাগ অর্থই সুইস ব্যাঙ্কে জমা রাখে। এই ভাবেই তারা দেশের আইনকে উপেক্ষা করে এবং কর ফাঁকি দেয়। যারা সুইস ব্যাঙ্কে টাকা জমা করে তারা তা প্রকাশ করে না এমন কি, তার পরিবারের কাছেও যাতে তারা ধরা না পড়ে। এই ভাবেই সেই ব্যক্তি যখন মৃত্যুমুখে পতিত হয় তখন কেউই সেই অর্থের মালিককে জানতে পারে না এবং সুইস সরকার অনায়াসেই সেই অর্থের গর্বিত মালিক হয়ে যায়। এটা সত্য যে, এই কারণেই সুইস কর্তৃপক্ষ এই সমস্ত অসৎ ব্যক্তিদের সুইস ব্যাঙ্কে টাকা জমা করতে অনুমতি দেয়।
৮ই নভেম্বর, ২০১৬ রাত্রি ৮.১৫ মিনিটে যখন 9 ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করলেন যে, আজ মধ্য রাত্রি হতে ৫০০ টাকা এবং ১০০০ টাকার নোট অচল হয়ে গেল, এটি যারা অসদুপায়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিল তাদের কাছে এক বিশাল ধাক্কা। হঠাৎই এই বিপুল সংগৃহীত অর্থরাশি নিমেষই অর্থহীন কাগজে পরিণত হলো। অনেকেই পরবর্তীকালে এই কালো টাকা সাদাতে পরিণত করতে গিয়ে ধরাও পড়ল। অনেকেই এই অর্থ পুড়িয়ে বা নদীতে ভাসিয়ে এর থেকে মুক্ত হতে চাইল । কিন্তু যারা টাকা সদুপায়ে অর্জন করেছিল তারা হয়রানির মধ্যে পড়েছিল কিন্তু বিরক্ত হয়নি । এই হয়রানি সহ্য করতে রাজী ছিল একটা ভালো দিশার সন্ধানের জন্য । অসদুপায়ে রোজগার মানুষকে ভয় এবং দুঃখ দেয়। ভক্তিবিনোদ ঠাকুর চিনির ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু ব্যবসা চলাকালীন তিনি দেখলেন যে, লাভ করার জন্য তাঁকে অনেক মিথ্যা কথা বলতে হচ্ছে। তাই তৎক্ষণাৎ তিনি ব্যবসা ত্যাগ করলেন।
শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন, ‘প্রতিটি নাগরিক শুধুমাত্র পর্যাপ্ত অর্থ তার পরিবারকে সুন্দর ভাবে প্রতিপালনেই এইং পারমার্থিক জ্ঞান বৃদ্ধিতে ই সন্তষ্ট নয়, যখন কিনা উভয়ই মানব জীবনে অপরিহার্য । বর্তমানে প্রত্যেকেই বিপুল পরিমাণ অর্থ চায় তার অতৃপ্ত ইচ্ছাগুলিকে তৃপ্ত করার জন্য। মানুষের অনৈতিক লিপ্সার সমানুপাতিক হারে তাদের রাশিকৃত অর্থ মায়া শক্তির প্রতিনিধিরা নিয়ে চলে যায় কখনো চিকিৎসক রূপে, কখনো উকিল রূপে, কখনো কর সংগ্রাহক রূপে, সামাজ সংস্কার নামে, কখনো স্বঘোষিত ধর্মগুরু রূপে, কখনো দুর্ভিক্ষে, কখনো ভূমিকম্পে এবং এরকম আরও অনেক দুর্যোগ। প্রকৃতপক্ষে এটিই প্রকৃতির আইন; যদি অর্থ ভগবানের সেবাতে না ব্যবহার করা হয় তাহলে সেটি ভস্মে ঘি ঢালার সামিল হবে কখনো আইন সমস্যা রূপে, কখনো ব্যাধি রূপে। মূর্খ লোকেদের এই সত্য চেনার দৃষ্টি নেই, তাই পরম পুরুষোত্তম ভগবানের আইন তাদেরকে বোকা বানায়’।
(কৃষ্ণভাবনামৃতের উন্নতি, অধ্যায়-২)
টাকা আমাদের বোকা বানায় আমরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছি যেখানে আমরা মনে করি অর্থই আমাদের সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা নিরসন করতে পারবে। খুব অল্পই আমরা আমাদের সংগৃহীত অর্থের প্রকৃত মূল্য অনুভব করতে পারি। আমরা সর্বাধিক সংগ্রহ করতে চাই। অর্থকেই নাম, যশ, ক্ষমতা এবং প্রতিপত্তির একমাত্র পথ বলে মনে করি। আমরা অর্থ সংগ্রহের দৌড়ে আমাদের স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দিই না এমনকি আমাদের প্রিয় নিকট আত্মীয়দেরকেও উপেক্ষা করি, কিন্তু অর্থেরও চরম সীমা আছে। অর্থ আমাদের হৃদয়কে চির নবীন করতে পারে না, আমাদের অশান্ত মন শান্ত করতে পারে না এবং দীর্ঘস্থায়ী সুখও প্রদান করতে পারে না।
শ্রীমদ্ভাগবত (৪/২২/৩৩) বলে, ‘মনুষ্য সমাজের এই শুধু মাত্র অর্থ রোজগারের চিন্তা এবং তা শুধুমাত্র ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্যই এটি প্রত্যেকের স্বার্থহানি করে।” আমরা সর্বদাই চিন্তা করি যে, আজ আমার যা সম্পদ আছে আমি আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী আরও অধিক পাবো, আজ আমার যা আছে ভবিষ্যতে আরও হবে, । (গীতা ১৬/১৩)
পারমার্থিক সম্পদের জন্য কর্ম করুন
বেদে সম্পদকেই অর্থ বলা হয়। অর্থ বলতে টাকাকে বোঝায়। তাই বেদে টাকাকে অর্থ পূর্ণ ভাবে ব্যবহার করার ঔচিত্যকে গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। বেদ সর্বদাই আমাদেরকে এটা মনে করতে বলেছে যে, আমরা আধ্যাত্মিক প্রকৃতি। আমরা এই ক্ষণস্থায়ী জগতের অঙ্গ নই। তাই আমাদের জীবনের লক্ষ্য এই জড় জগতে লিপ্ত হওয়া নয়। কারণ, এই জড় জগতে আমরা যা কিছুই সংগ্রহ করি না কেন একদিন তা আমাদের থেকে কেড়ে নেওয়া হবে। যখন যম দুতেরা আমাদের দরজাতে কড়া নাড়বে তখন আমরা তাদেরকে এই কাগজের টাকাগুলি দিয়ে ঘুষ দিতে পারবো না এবং প্রকৃতপক্ষেই এইগুলি আমাদের জন্য অর্থহীন হয়ে যাবে। যখন আমরা এই পৃথিবী ত্যাগ করবো আমরা একটি পয়সাও এই পৃথিবী থেকে নিয়ে পারবো না। এই জড় জগতে তাই আমাদের আধ্যাত্মিক সম্পদ সংগ্রহের প্রতি আগ্রহী হতে হবে, কারণ আমরা যাই আধ্যাত্মিক সম্পদ আহরণ করি তা আমাদের নিত্য ভগবদ্ ব্যাঙ্কে জমা হয়, এটি কখনো নষ্ট হয় না, বরং নিত্য সুখের দ্বার উন্মোচন করে ।
শঙ্করাচার্য তাঁর ভজ গোবিন্দম্ প্রার্থনাতে খুব সুন্দর ভাবে বলেছেনঃ “হে মূর্খ! অর্থ সংগ্রহের পিপাসা ত্যাগ কর পরমার্থের প্রতি মনোনিবেশ কর। বিগত কর্মের ফলের প্রতি বিশ্বাস রেখে। সম্পদ, যৌবন এবং সঙ্গের গর্ব করো না। এইগুলি প্রত্যেকটিই মুহূর্তেই বিনষ্ট হয়। তাই এই মিথ্যা মায়ার সংসার থেকে নিজেকে মুক্ত করো এবং অন্তহীন পরম সত্যকে অর্জন কর।
হে মূঢ় জীব! সম্পদের চিন্তায় এত একাত্ম কেন? এখানে কেউ পথপ্রদর্শক নেই ত্রিভুবনে একমাত্র একটি বস্তুই আছে যা তোমাকে ভবসমুদ্র পার করতে পারে । দ্রুত সৎসঙ্গের তরণীতে আরোহণ করো। (প্রকৃত জ্ঞান) শ্রীল প্রভুপাদ শ্রীমদ্ভাগবতের ৫/২৬/৩৬ শ্লোকের তাৎপর্যে উল্লেখ করেছেন, “কেউ যখন প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধন অর্জন করে, তখন সে অবশ্যই অত্যন্ত গর্বিত হয়ে ওঠে। আধুনিক সভ্যতায় মানুষের অবস্থা ঠিক সেই রকম। এই যুগে সুযোগ্য ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় অথবা বৈশ্য নেই এবং সকলেই শূদ্রে পরিণত হয়েছে (কলৌ শূদ্রসম্ভবাৎ), তাই আধুনিক সভ্যতায় শূদ্র মনোভাবের ফলে প্রচুর ক্ষতি হচ্ছে। ভগবানের সেবার উদ্দেশ্যে যে কিভাবে অর্থের সদ্ব্যবহার করতে হয়, তা শূদ্রেরা জানে না। সম্পদকে বলা হয় লক্ষ্মী এবং লক্ষ্মীদেবী সর্বদা নারায়ণের সেবায় যুক্ত। তাই ধন-সম্পদ নারায়ণের সেবায় লাগানো অবশ্য কর্তব্য। সকলেরই কর্তব্য কৃষ্ণভাবনামৃতের মহান আন্দোলন প্রচার করার উদ্দেশ্যে তাদের ধন-সম্পদ ব্যবহার করা। তা না করে কেউ যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধন সংগ্রহ করে, তা হলে সে অবশ্যই ধনমদে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধন যদি থাকে, তা হলে তা শ্রীকৃল্পের জন্য ব্যয় করা উচিত। তা না করা হলে, মানুষ তার মিথ্যা সম্পদের গর্বে গর্বিত হবে এবং তার ফলে পরবর্তী জীবনে তাকে এই শ্লোকের বর্ণনা অনুসারে নরক-যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পাঠ করা উচিত, একবিন্দু পবিত্র গঙ্গাজল পান করা উচিত, অন্ততঃ একবার মুরারীর (কৃষ্ণ) পূজা কর। তার তখন যমের (মৃত্যুর দেবতা) সাথে কোন বিতর্ক থাকবে না। রোজ ভগবদ্গীতা পাঠ কর। হৃদয়ে শ্রীবিষ্ণুর ধ্যান কর, তাঁর সহস্র লীলা কীর্তন কর। পরম এর পবিত্র সঙ্গ কর। নিজের সম্পদ দীন দরিদ্রদের বিতরণ কর।’ সম্পদ উন্নতি নয়। প্রকৃতপক্ষে এত কোন আনন্দ নেই। সর্বদাই চকচক করে। ধনী ব্যক্তি সর্বদাই ভীত থাকেন এমনকি নিজের সন্তানের কাছেও । সর্বত্র এই হচ্ছে সম্পদদে প্রকৃত রূপ। শঙ্করাচার্য উপদেশ দিয়েছেন, ‘ভজ গোবিন্দম ভজ গোবিন্দম্ ভজ গোবিন্দম্ মূঢ়মতে।”
লেখক: পুরুষোত্তম নিতাই দাস ইস্কন কোলকাতার ভক্তিবৃক্ষের একজন সদস্য। বর্তমানে তিনি টেক মহিন্দ্রায় কর্মরত।
এপ্রিল-জুন ২০১৮ ব্যাক টু গডহেড