অষ্টাঙ্গযোগ, কুন্ডলিনী ও ভক্তি

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ | ৮:৫২ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ | ৮:৫২ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 480 বার দেখা হয়েছে

অষ্টাঙ্গযোগ, কুন্ডলিনী ও ভক্তি

বৈদিক ধারায় বর্ণিত প্রাচীন যোগব্যবস্থা দীর্ঘ এবং দুষ্কর। প্রাচীন সাধক পতঞ্জলি কর্তৃক পুনঃগঠিত অষ্টাঙ্গযোগ বা আট ধাপ বিশিষ্ট যোগ পদ্ধতি বলা হয়। এটি চেতনাকে ধীরে ধীরে উন্নত মার্গে উন্নীত করে যার চূড়ান্ত সীমা হচ্ছে সমাধি। উন্নত করার একটি বিজ্ঞানসম্মত ও আধ্যাত্মিক পদ্ধতি। সেই স্তরে জীব তার স্বরূপ উপলব্ধি করে, এই নশ্বর দেহের আবরণ ত্যাগ করে এবং মুক্তাবস্থা প্রাপ্ত হয়। অষ্টাঙ্গযোগের ক্রমোন্নতির আটটি ধাপগুলো হল: যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি। আমি অষ্টাঙ্গ যোগের প্রতিটি ধাপ সংক্ষেপে বর্ণনা করব এবং এরপর ভক্তিযোগের সাথে অষ্টাঙ্গযোগের তুলনা করব।

যম ও নিয়ম:

প্রথম দুটি নীতি, যম ও নিয়ম হল: বিধি এবং নিষেধসমূহ এবং এগুলো শুধুমাত্র জাগতিক বা পারমার্থিক ফলতা প্রত্যাশী নির্বিশেষে প্রতিটি ব্যক্তির জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োজন, এর মূল মন্ত্রটি হল বৈরাগ্য কিঞ্চিৎ মাত্রায় হলেও বৈরাগ্য অনুশীলন ব্যতীত আমরা আমাদের বাসনা পূর্ণ করতে পারি না বা জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি না। আমাদের ব্যবহারিক জীবন এটি সমর্থন করে। ছোট বেলায় আমার এক বন্ধু ছিল যে হাত খরচের টাকা সঞ্চয় করত। আমরা বাকীরা যেভাবে অনিয়ন্ত্রিতভাবে মিষ্ট সামগ্রী ও সিনেমা দেখার জন্য ব্যয় করতাম তার পরিবর্তে সে টাকা জমাতো এবং অবশেষে সে ষ্টোরিও যন্ত্রপাতি কেনার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ সঞ্চয় করেছিল। এর দ্বারা আমি খুবই প্রভাবিত হয়েছিলাম। আমার কাছে এটি ছিল এক দুর্বোধ্য কৃতিত্ব। কারণ আমি কখনোই অর্থ সঞ্চয় করিনি। সব সময় আমি আমার সর্বস্ব একসাথেই ব্যয় করে ফেলতাম।
পরবর্তীতে সেই বন্ধুটি একজন সফল ডাক্তার হয়েছিল, উচ্চ মাধ্যমিক ও কলেজে পড়ার সময় যখন তার বন্ধুরা বাইরে পার্টি আর মজা করত, তখন সে বাসায় পড়াশুনা করত এবং পরীক্ষার প্রস্তুতি নিত। তখন আমি উপলব্ধি করলাম যে, দীর্ঘ মেয়াদী সফলতা লাভের জন্য, স্বল্প মেয়াদী অনেক আনন্দ ত্যাগ করতে হয়। মানুষের তার নিজের ইন্দ্রিয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। ইন্দ্রিয় সংযম ব্যতীত জাগতিক বা পারমার্থিক সফলতা লাভের কোন সম্ভাবনা নেই। যে কোন প্রকৃত যোগ পদ্ধতির প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল ইন্দ্রিয় সংযম এবং অষ্টাঙ্গযোগ খুব কষ্ট সাধ্য ও সুসংবদ্ধ উপায়ে তা করা হয়।

প্রথাগত যোগ সাধনার ধাপগুলোর প্রতি গভীর দৃষ্টিপাতের মাধ্যমে বোঝা যায় কেন সেটি আধুনিকযুগের জন্য অনুপযুক্ত

১ম ধাপ: ‘যম’ হল লক্ষ্য অর্জনে প্রতিবন্ধক সৃষ্টিকারী বস্তু ত্যাগ করা। উদাহরণ স্বরূপ, অবৈধ যৌনসঙ্গ, টেলিভিশন, সিনেমা দেখা, নেশা করা এবং মাছ, মাংস ও ডিম এরকম নির্দিষ্ট কিছু খাদ্য বর্জন করা। এসমস্ত জিনিস চেতনাকে দূষিত করে আত্মার প্রতি মনোযোগ বিচ্ছিন্ন করে এবং তা দেহ গত চাহিদা ও বাহ্যিক বস্তুর প্রতি নিবিষ্ট করে।
২য় ধাপ: ‘নিয়ম’ হল দৈনন্দিন ধ্যান ধর্মানুষ্ঠান, অনুশীলনের মত সহায়ক কার্যকলাপগুলো যা যোগের চুড়ান্ত লক্ষ্য ভগবানের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য করতে হয়।
অষ্টাঙ্গযোগে যে কোন মূল্যেই একজন যোগীকে যৌনসঙ্গ পরিত্যাগ করতে হয়। সম্পূর্ণ বৈরাগ্য অনুশীলন ব্যতীত এই ধারায় সফলতা লাভ সম্ভব নয়। প্রচলিত জড় জাগতিক সুখ আমাদের নিজেদের বাইরে অন্য কোন কিছু থেকে অনুসৃত হয়। আমরা নিজেদের ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বাহ্যিক কোন বস্তু বা অন্য কোন দেহে বা দেহগত সুখ অন্বেষেণ করি যেমন নাম, যশ। ক্ষমতা উপাধিরূপে মানসিক সন্তুষ্টির অন্বেষণ করি। যাই হোক, অষ্টাঙ্গযোগ আত্মস্থিত গভীরতর আনন্দের দ্বার উন্মুক্ত করে। কিন্তু সেই গূঢ় আনন্দের জগতে প্রবেশের পূর্বে, একজন ব্যক্তিকে অবশ্যই জড় বিষয় থেকে ইন্দ্রিয় গুলো নিবৃত্ত করতে হবে। অর্থাৎ, যোগ সাধনার দ্বারা যে সুখ লাভ হয়, সেটি ইন্দ্রিয় সুখ নয়। ইন্দ্রিয় সুখ প্রকৃত পক্ষে আসল (অকৃত্রিম সুখ) নয়, কেননা এটি নিশ্চিতরূপে দুঃখ ডেকে আনে।
যে হি সংস্পর্শজা ভোগা দুঃখযোনয় এব তে। আদ্যন্তবন্তঃ কৌন্তেয় ন তেষু রমতে বুধঃ ॥
অর্থাৎ বিবেকবান পুরুষ দুঃখের কারণ যে ইন্দ্রিয়জাত বিষয়ভোগ তাতে আসক্ত হন না। হে কৌন্তেয়! এই ধরনের সুখভোগ আদি ও অন্তবিশিষ্ট। তাই জ্ঞানী ব্যক্তিরা তাতে প্রীতি লাভ করে না। (গীতা ৫/২২)

আসন

৩য় ধাপ: ‘আসন’ পাশ্চাত্যবাসীদের কাছে হঠ-যোগ নামে পরিচিত। এই অভ্যাসটির দ্বারা দেহকে দীর্ঘক্ষণ বিভিন্ন ভঙ্গি বা অঙ্গবিন্যাসে রাখতে প্রস্তুত করে। এটি দেহকে স্বাস্থ্যবান ও ক্ষীণ (পাতলা) রাখে। কিন্তু এর প্রকৃত উদ্দেশ্য হল ধীরে ধীরে ঘন্টা বা দিন ব্যাপী, পরিশেষে এমনকি মাস এবং বছর ব্যাপী দেহকে একই অবস্থানে রাখার জন্য প্রশিক্ষিত করে তোলা। উদাহরণ স্বরূপ যতক্ষণ পর্য়ন্ত, একজন ব্যক্তি কোন রূপ নাড়াচাড়া এবং অস্বস্তি ছাড়া ঘন্টা বা দিনব্যাপী পদ্মাসনে অবস্থান করতে পারবে না, ততক্ষণ তিনি নফল ভাবে কুন্ডলিনী উন্মোচন করতে পারবে।

প্রাণায়াম

অনেক বছর ব্যাপী আসন বা হঠযোগ অনুশীলনকারী দক্ষ যোগী এর পর শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে কাজ করবে, যেটি হল পরবর্তী ধাপ, প্রাণায়াম। সহজভাবে বলতে গেলে, প্রাণায়ামের লক্ষ্য হল ধীরে ধীরে শ্বাস-প্রশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করা বা কমিয়ে আনা। বৈদিক ঐতিহ্য বলে যে, সমস্ত জীবের জীবনকাল তাদের নিশ্বাসের সংখ্যার দ্বারা পূর্বে নির্ধারিত হয়ে আছে। শ্বাসচক্র কমিয়ে আনার মাধ্যমে, একজন সিদ্ধ যোগী তার জীবন কালকে অনেক বছর বা এমনকি অনেক দশক বা শতাব্দী পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করতে পারেন। এটির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, কারণ অষ্টাঙ্গযোগের বিভিন্ন কৌশলে দক্ষতা অর্জনে অনেক দীর্ঘ সময়ের দরকার হয়। শ্রীমদ্ভাগবতমে ধ্রুব মহারাজ নামক, এক রাজপুত্রের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, যিনি ভগবান বিষ্ণুর দর্শন লাভের জন্য বনে গিয়ে তপস্যা করেছিলেন। তিনি ততটাই দৃঢ়ভাবে যোগ সাধনা করেন যে, শেষের দিকে তিনি কেবল গাছের পাতা আহার করতেন।
তিনি এক পায়ে দাড়িয়ে প্রাণায়াম অনুশীলন করতেন , ধীরে ধীরে শ্বাস-প্রশ্বাস কমিয়ে এনেছিলেন, যেটি ছিল ছয় মাসে একবার। যাইহোক, প্রাণায়ামের প্রকৃত উদ্দেশ্য, মানুষে জীবনকালকে দীর্ঘায়িত করার চেয়ে বেশি কিছু। প্রকৃত লক্ষ্য হলো, সমাধি স্তরে উন্নীত হওয়া ও ধ্যান করা, প্রথমে প্রাণ (প্রাণবায়ু) এবং চক্রের (শক্তি বিন্দু) উপর, তারপর আত্মার উপর এবং পরিশেষে অন্তঃস্থিত পরমাত্মার উপর। ক্রমশ শ্বাস প্রক্রিয়া আস্তীর্ণ (সম্প্রসারণ) করার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তার দেহ ও মনের কার্যকলাপ রূদ্ধ করতে পারেন। মন যখন শান্ত হয়, তখন যোগী তাকে বাহ্যিক জড় জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করে হৃদয়ে নিবদ্ধ করতে পারে। মনকে শান্ত করার জন্য “একটি গভীর শ্বাস নাও” সেই ব্যাপারটি আমরা সবাই জানি, এটি ফলপ্রদ।

প্রত্যাহার

যে যোগী তার শ্বাসক্রিয়াকে আয়ত্ত করেছেন (যেভাবে গীতায় বলা হয়েছে, “অপান বায়ুকে প্রাণবায়ুতে, আহুতি দেয়া”)। তিনি পরবর্তী ধাপে, ‘প্রাণায়াম’ অগ্রসরের জন্য প্রস্তুত, যেখানে ইন্দ্রিয়গুলোকে সমস্ত বাহ্যিক কার্যকলাপ থেকে নিবৃত্ত বা প্রত্যাহার করা হয়। আত্মা মনকে বাহ্য জগৎ থেকে নিবৃত্ত করে হৃদয়ে স্থির করে। জড় বিষয় ও জাগতিক সম্পর্কে নিবিষ্ট ইন্দ্রিয় সমূহকে জোর পূর্বক প্রত্যাহার করে, হৃদয়ে আধ্যাত্মিক জগতে কেন্দ্রীভূত করা হয়। মনোজগতটি সূক্ষ্ম। কেউ কেউ এটিকে সূক্ষ্ম দেহ বলে। প্রত্যাহারে চেতনা জড় স্তর থেকে মনগত স্তরে নিবিষ্ট হয়। এই দুই স্তরের ঊর্ধ্বে বা অপ্রাকৃত স্তর হল শুদ্ধ চেতনার স্তর, যে স্তর লাভের জন্য যোগী সমস্ত প্রয়াস করে থাকে।

ধারণা

অধিকতর কঠোর অনুশীলনের দ্বারা যোগী তার চেতনাকে ধারণার স্তরে উন্নীত করতে সক্ষম হয়। যেখানে মনের অভ্যন্তরীণ সূক্ষদেহে পূর্ণরূপে নিবদ্ধ হয়। ইন্দ্রিয়গত সমস্ত কার্যকলাপের নিবৃত্তি ঘটিয়ে, যোগী কেবল আত্মচেতনা স্থিত হন। রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ, স্পর্শের কোনো রূপ অনুভব থাকে না এবং এভাবে জড় জগত সম্পর্কে চেতনা রহিত হয়। যখন কেউ ধারণার স্তরে পৌঁছায় তখন ধ্যানের শুরু হয়।

ধ্যান

আধুনিক বিশ্বে মানুষ যে কোন ধরণের সমাবেশ বা একাগ্রতাকে বোঝানো জন্য “ধ্যান” শব্দটি সস্তাভাবে ব্যবহার করছে। এমনকি কেউ কেউ ভাবে যে কেবলমাত্র বসে থাকা। আয়েশ করা এবং মনকে ইচ্ছামত বিচরণ করতে দেয়া, সেটিই ধ্যান অথবা আরো উন্নতি প্রক্রিয়ার শুধুমাত্র একটি অগ্নিশিখা বা দেয়ালের কোন বিন্দু বা বৃত্তে পাঁচ মিনিট সময় ধরে তাকিয়ে থাকাটাই ধ্যান। যাইহোক আমাদের এটি জানা উচিত যে, বৈদিক শাস্ত্রে বর্ণিত প্রাচীন যোগ সাধনা করা কখনই সম্ভব নয়, যদি না সে ব্যক্তি বাহ্যিক ইন্দ্রিয়গত কার্যকলাপ থেকে পূর্ণরূপে মুক্ত না হয় এবং আত্মচেতনায় স্থিত না হয়। শুধুমাত্র তখনই একজন ব্যক্তি ধ্যানের স্তরে উন্নীত হতে পারেন।
তখন যোগী ধ্যান করতে শুরু করেন এবং প্রকৃত দ্রষ্টা, আত্মাকে প্রত্যক্ষ করেন। পরিশেষে হৃদয়ে চেতনার চিৎকণা রূপে আত্মা তার স্বরূপ দর্শন করে। প্রকৃত স্বরূপ জানার পর, একজন পূর্ণ যোগী সর্ব জীবের হৃদয়ে অবস্থানকারী ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে পরমাত্মারূপে দর্শন করেন। অনেক সময় অহংকার ও স্বল্প জ্ঞানের কারণে ভুলবশত যোগী পরমাত্মাকে নিজের স্বরূপ বলে মনে করে এবং নিজেকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বলে সিদ্ধান্ত করে।
এই রকম ভ্রান্ত যোগীরা বৈকুণ্ঠে, যে চিৎগ্রহে ভক্তরা নিত্যকাল পরমেশ্বর ভগবানের প্রেমময় সেবা করছেন, সেখানে পৌঁছাতে পারেনা। কিন্তু তারা ভগবানের অঙ্গ নিঃসৃত জ্যোতি, নির্বিশেষ ব্রহ্মে লীন হয়ে যায়। আর এইভাবে হৃদয়ে পরমাত্মাকে দর্শনকারী যোগী হয় বিনীতভাবে ভগবানের নিকট আত্মসমর্পন করে অথবা জড়জগত থেকে মুক্তি লাভ করে। এটাই একজন যোগীর জন্য চরম পরীক্ষা: ব্রহ্মে লীন হয়ে জাগতিক উচ্চ স্থান লাভে করা অথবা ভগবানের বিনীত সেবক হওয়া। যোগী যে লক্ষ্য নিধারণ করবে, সেটিই অর্জিত হবে।

 সমাধি

যোগী ধ্যানের চূড়ান্ত লক্ষ্য ধ্যানে প্রবেশ করে এবং যেটিকে মাঝে মাঝে কুণ্ডলিনী বলা হয়, সে প্রক্রিয়া শরীর ত্যাগ করতে প্রস্তুত। যোগী তখন আত্মাকে ব্রহ্মরন্ধ্র দিয়ে নির্গত করে এবং ঐ মুহূর্তে তার চেতনা যেখানে স্থিত সেখানে গমন করে। বৈদিক সাহিত্যে বর্ণিত সেই সমস্ত যোগীদের কাহিনীতে দেখা যায় যে, এইভাবে নির্গত শক্তি এতই অসীম যে, মাঝে মধ্যে তার দ্বারা যোগীর দেহ অগ্নিতে ভস্মীভূত হয়। শ্রীমদ্ভাগবতম থেকে আমরা জানতে পারি যে, এইভাবে দেহ ত্যাগ করার জন্য মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র যখন বনে গমন করলেন, তখন তার দ্বারা একটি দাবানলের সূত্রপাত হয়েছিল। তার সাধ্বী পত্নী গান্ধারীও মুক্তি লাভের জন্য একত্রে সেই অগ্নিতে প্রবেশ করেছিলেন।
শুধু সমাধি স্তরে উন্নতি হলেই কেউ কুণ্ডলিনী মুক্ত করতে পারে। যোগী প্রাণ বায়ুকে সর্বনিম্ন চক্র, মূলচক্র থেকে ধীরে ধীরে শরীরে অন্যান্য চক্রে উত্তোলন করে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটি হৃদয় চক্রে পৌঁছায়। সেখান থেকে আত্মা মস্তকের উপরে সর্বোচ্চ চক্রে উন্নীত হয়।
বিভিন্ন চক্রের দ্বারা প্রাণবায়ুকে উত্তোলনের ফলে কণ্ডলিনী মুক্ত হয়। যেহেতু কুণ্ডলিনী ঊর্ধ্বগতি প্রাপ্ত হয়, তখন দেহের ভিতরের চাপ এত বেড়ে যায় যে, যোগীকে অবশ্যই তখন রপ্তকৃত আসন ও প্রাণায়াম এর কৌশল ব্যবহার করে দেহের সমস্ত ছিদ্র বন্ধ করে দিতে হয়, যাতে করে আত্মা যেন এ সমস্ত ছিদ্রের কোনটি দিয়ে বের হয়ে না যায়। বৈদিক শাস্ত্রে এই জড় শরীরকে ‘নব দ্বারের শহর’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
সেই নয়টি দ্বার হল পায়ুপথ, জনেন্দ্রিয়, মুখ, দুই নাসিকা, দুই কর্ণ ও দুই চোখ। এই আধুনিক যুগে এই প্রকার যোগ অনুশীলন অত্যন্ত দুরহ। প্রাচীন কালের যোগীরা এই অষ্টাঙ্গযোগ অনুশীলনের জন্য বনে গমন করতেন এবং সেখানেই তাদের শরীর ত্যাগ করতেন।
কলিযুগে বর্তমান সময়ে পারমার্থিক পূর্ণতা সাধনের জন্য বৈদিক শাস্ত্র অষ্টাঙ্গযোগের ন্যায় কঠোর অনুশীলনে সমর্থন করে না। তার পরিবর্তে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপের সরল ও মহিমান্বিত উপায় যেখানে সেখানে অনুশীলন করা যায়, এমনি কোলাহলপূর্ণ শহরের একটি কক্ষে বসেও।
প্রকৃতপক্ষে ব্যস্ততাময় শহরের কোন একটি কক্ষে বসে ভগবানের পবিত্র নাম জপ করার মাধ্যমে যে কেউ হিমালয়ে ১,০০,০০০ বছর ধরে অষ্টাঙ্গযোগানুশীলনের চেয়েও বেশি সুফল লাভ করতে পারে, যেটি সত্যযুগে মানুষের স্বাভাবিক আয়ুষ্কালের সমান এবং তখন ধ্যান যোগ অনুশীলন একটি সাধারণ নিয়ম ছিল।
ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন, যে ব্যক্তি ভক্তির যোগ অনুশীলন করেন তিনি অন্য সমস্ত যোগ অনুশীলনের ফলও প্রাপ্ত হন এবং শ্রীমদ্ভাগবতমে (১২/৩/৫২) বলা হয়েছে

কৃতে যদ্ধ্যায়তো বিষ্ণুং ত্রেতায়াং যজতো মখৈঃ।
দ্বাপরে পরিচার্যায়াং কলৌ তদ্ধরিকীর্তনাৎ ॥

অনুবাদ: সত্যযুগে শ্রীবিষ্ণুর ধ্যান করে, ত্রেতা যুগে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করে এবং দ্বাপর যুগে ভগবানের চরণ পরিচর্যার মাধ্যমে যা কিছু ফল লাভ হয়, কলিযুগে শুধু হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করার মাধ্যমেই সেই ফল লাভ হয়ে থাকে।
বর্তমান যুগে মানুষ এতই উপদ্রুত যে, তারা দীর্ঘ সময় বসে থাকতে বা প্রাচীন যোগ সাধনা অনুশীলন করতে পারে না। হয়ত এখনো কিছু যোগী হিমালয়ের নির্জন গুহায় বসে এই পদ্ধতি অনুশীলন করতে পারেন, কিন্তুু সাধারণ মানুষের জন্য সেটি অসম্ভব। এই যোগ পদ্ধতিতে আগ্রহী ঐকান্তিক শিষ্যকে পরিচালনা করার মত সেরকম যোগ্যতাসম্পন্ন গুরু এখন আর নেই।
অষ্টাঙ্গযোগ ও ভক্তিযোগের মধ্যকার মৌলিক পার্থক্য হল, প্রথমটিতে যোগী তার মন ও বুদ্ধির দ্বারা উন্নতি সাধনের জন্য নিজেই চেষ্টা করে। ভক্তিযোগের মাধ্যমে আমরা কৃষ্ণের নিকট প্রার্থনা করি যেন, তিনি আমাদের খুঁজে নেন এবং তাঁর কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যান।
এই দুটি যোগ পদ্ধতির মধ্যে যে পার্থক্য সেটিকে শ্রীল প্রভুপাদ, মায়ের দ্বারা ধৃত বা বহনকৃত বিড়াল বা বানর ছানার পার্থক্যের সাথে তুলনা করেছেন। বাচ্চা বানর সমস্ত শক্তি দিয়ে তার মাকে আঁকড়ে ধরে রাখে। যখন মা বানরটি এই গাছ থেকে ঐ গাছে লাফিয়ে বেড়ায়, তার বাচ্চাটি তখন আলগা হয়ে ভূমিতে পতিত হতে পারে।
অন্যদিকে বিড়ালছানা শুধুমাত্র মায়ের শক্তির উপর নির্ভর করে নিরাপদভাবে তার মায়ের দ্বারা বাহিত হয়। একইভাবে, ভক্তিযোগী কৃষ্ণ ছাড়া অসহায় অনুভব করে, তাঁর উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হন, অষ্টাঙ্গযোগী নিজের ক্ষমতা দিয়ে ভবসাগর পাড়ি দেওয়ার জন্য সংগ্রাম করে, যেখানে সফলতার কোন নিশ্চয়তা নেই। কিন্তুু যিনি কৃষ্ণের চরণে আত্মসমর্পণ করেন তিনি সহজেই মায়াকে অতিক্রম করতে পারেন।

দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া
মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তিতে।

অনুবাদ: আমার এই দৈবী মায়া ক্রিগুণাত্মিকা এবং তা দুরাতিক্রমণীয়া। কিন্তু যারা আমাতে প্রপত্তি করেন, তাঁরাই এই মায়া উত্তীর্ণ হতে পারেন।” (গীতা /৬/১৪) মৃত্যুর সময় প্রাণ ও চক্রকে পরিচালনা করে আত্মাকে ব্রহ্মরন্ধ্রে উত্তোলনের চেয়ে, ভক্তিযোগ বহু বহু গুণে সহজ এবং নিরাপদ। ভক্তিযোগে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ভক্তকে চরম লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করেন।

লেখক পরিচিতি: জম্বুদ্বীপ দাস ১৯৮২ সালে ইস্‌কন কোপেনহেগেনে যুক্ত হন। তাঁর অর্পিত সেবার মধ্যে রয়েছে গ্রন্থ বিতরণ, রেডিও কৃষ্ণ এবং ভক্তিবেদান্ত বুক ট্রাস্টের জন্য অনুবাদ ও সংশোধন। গত নয় বছর ধরে তিনি এবং তাঁর সহধর্মিণী ব্রজসেবকী দাসী মায়াপুরে বাস করেন। যেখানে তিনি ইস্কনের গ্রন্থও সাময়িকীয় পরিকল্পনা ও নকশা করেন।

জানুয়ারি-মার্চ ২০১৯ সালে প্রকাশিত ।। ৭ম বর্ষ ।। সংখ্যা ১।।

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।