এই পোস্টটি 193 বার দেখা হয়েছে
কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ
প্রতিষ্ঠাতা-আচার্য: আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইস্কন) ১৯৭৩ সালের ৭ মে আমেরিকার লস্ এঞ্জেলেসের প্রশান্ত মহাসাগরের সৈকতে প্রাতঃভ্রমণের সময় তাঁর বৈজ্ঞানিক শিষ্য ডঃ পৌডম সিংয়ের (শ্রীমৎ ভক্তিস্বরূপ দামোদর স্বামী মহারাজ) এর মধ্যে কথোপকথনের অংশবিশেষ।
শ্রীল প্রভুপাদ : যোগীরা বিভিন্ন রকমের অলৌকিক শক্তি লাভ করার চেষ্টা করে। একজন যোগী জলের ওপর হাঁটতে পারে। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তার ওপর কার্যকরী হয় না। এই ধরনের অলৌকিক শক্তিকে বলা হয় ‘লঘিমা’। ‘লঘিমা’ মানে হচ্ছে একজন মানুষ তুলোর থেকেও হালকা হয়ে গিয়ে মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম ব্যাহত করতে পারে। যে অচিন্ত্য শক্তি আমাদের মধ্যে রয়েছে, যোগ অভ্যাসের ফলে তার প্রকাশ হয়। (সমুদ্রে ক্রীড়ারত কতকগুলি ছেলেকে দেখিয়ে) এই ছেলেগুলি সাঁতার কাটছে, কিন্তু আমি সাঁতার কাটতে পারি না। কিন্তু সাঁতার কাটার ক্ষমতা আমার মধ্যে রয়েছে; আমাকে কেবল অভ্যাস করে সেটা আয়ত্ত করতে হবে। তেমনই মানুষের যদি এত সমস্ত যৌগিক শক্তি থাকতে পারে, তাহলে একবার ভেবে দেখ ভগবানের যোগ-শক্তি কি রকম। বৈদিক শাস্ত্রে তাঁকে বলা হয়-যোগেশ্বর, অর্থাৎ “সমস্ত যৌগিক শক্তির তিনি হচ্ছেন ঈশ্বর।” ভগবদ্গীতায় (১০/৮) শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, অহং সর্বস্য প্রভবো মত্তঃ সর্বং প্রবর্ততে “আমি হচ্ছি জড় এবং চেতন সবকিছুরই উৎস। আমার থেকেই সবকিছুর প্রকাশ হয়।” ভগবানের এই উক্তি যদি আমরা মেনে না নিই, তাহলে জড় প্রকৃতির উৎস সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানতে পারব না। তাঁর অচিন্ত্য শক্তি স্বীকার না করে নিলে ভগবানকে জানা যায় না, কিন্তু বিজ্ঞানসম্মতভাবে তুমি যদি ভগবানকে জানতে পার, তাহলে তুমি সবকিছুই জানতে পারবে।
ড. সিং: তাহলে কি আপনি বলতে চান যে, আধুনিক বিজ্ঞানের শুরু হয়েছে একটি মধ্যবর্তী স্তর থেকে—মূল উৎস থেকে নয়?
শ্রীল প্রভুপাদ: হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। উৎস সম্বন্ধে তাদের কোন জ্ঞান নেই। বৈজ্ঞানিকেরা একটা মধ্যবর্তী স্তর থেকে তাদের গবেষণা শুরু করে-কিন্তু সেটির উৎস কোথায়? তাদের এত সমস্ত গবেষণা সত্ত্বেও সেটা তারা জানে না। সমস্ত অলৌকিক শক্তি এবং সবকিছু যাঁর থেকে প্রকাশিত হয়, সেই পরমেশ্বর ভগবানই যে সবকিছুর উৎস, সেটা মেনে নিতেই হবে। আমরা অন্ধ বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে সিদ্ধান্ত করছি না; আমরা যা বলছি, সেটা যথার্থ বিজ্ঞানের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। জীবন থেকে জড়ের উদ্ভব হয়। জীবন-উৎসের মধ্যে-অনন্ত সমস্ত জড় পদার্থের প্রকাশে সম্ভাবনা রয়েছে; সেটাই হচ্ছে সৃষ্টির সবচাইতে বড় রহস্য। তুমি যদি একটা ছুঁচ ফেল, তাহলে সেটা তৎক্ষণাৎ মাটিতে পড়ে যাবে, কিন্তু তার থেকে অনেক ভারী যে একটা পাখী সেটা স্বচ্ছন্দে আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। এইভাবে আকাশে ভাসার ক্ষমতা তার মধ্যে এল কোথা থেকে, সেটা বিচার করে দেখতে হবে। তুমি যদি প্রকৃতিকে বিশ্লেষণ কর, তাহলে দেখবে যে প্রতিটি জীবের মধ্যে কিছু না কিছু অলৌকিক শক্তি রয়েছে। একটা মানুষ কয়েক ঘণ্টার বেশি জলে থাকতে পারে না, কিন্তু একটা মাছ নিরন্তর সেখানে বাস করছে- সেটা কি অলৌকিক শক্তির প্রকাশ নয়?
ড. সিং: আমার কাছে সেটা অলৌকিক শক্তি, কিন্তু মাছের কাছে নয় ।
শ্রীল প্রভুপাদ: হ্যাঁ। তার কারণ হচ্ছে অলৌকিক শক্তি সমানভাবে বিতরণ করা হয়নি। কিন্তু সমস্ত অলৌকিক শক্তি ভগবানের মধ্যে রয়েছে, তিনিই হচ্ছেন সবকিছুর উৎস। তাঁর থেকে কিছুটা অলৌকিক শক্তি আমি পেয়েছি, তুমি পেয়েছ, পাখীরা পেয়েছে। এভাবে সকলেই তাঁর থেকে কিছু কিছু অলৌকিক শক্তি পেয়েছে, কিন্তু সমস্ত অলৌকিক শক্তির ভাণ্ডার ভগবান স্বয়ং। মূলতঃ আট রকমের অলৌকিক শক্তি রয়েছে। সেগুলি হচ্ছে—
১। অণিমা (অত্যন্ত ক্ষুদ্র হওয়ার ক্ষমতা),
২। মহিমা (পর্বতের থেকেও বড় হওয়ার ক্ষমতা),
৩। লঘিমা (তুলা থেকেও হালকা হওয়ার ক্ষমতা)
৪। প্রাপ্তি (যে কোনো জায়গা থেকে ইচ্ছা অনুসারে যে কোনো কিছু পাওয়ার ক্ষমতা)
৫। ঈশিতা (ইচ্ছা অনুসারে কোন কিছুর সৃষ্টি অথবা ধ্বংস করার ক্ষমতা)
৬। বশিতা (কাউকে বশ করার ক্ষমতা)
৭। প্রকাম্য (ইচ্ছা অনুসারে যা কিছু করার ক্ষমতা)
৮। কামবশীতা (অসাধ্য সাধন করার ক্ষমতা)। এই অলৌকিক শক্তিগুলিকে বলা হয় যোগসিদ্ধি ।
সূর্যের মধ্যে আর একরকম অলৌকিক শক্তি দেখা যায়। যেমন, সূর্য রশ্মির থেকে অসংখ্য জিনিস অনির্বচনীয়ভাবে সৃষ্টি হচ্ছে। অলৌকিক শক্তির অস্তিত্ব যদি বৈজ্ঞানিকেরা স্বীকার না করে, তাহলে তারা কোনকিছুরই ব্যাখ্যা করতে পারবেন না । তারা যা করছে সেটা কেবল কতকগুলি অনুমান মাত্ৰ ৷
ড. সিং: একজন ধূর্ত বৈজ্ঞানিক তার বক্তব্য প্ৰমাণ করার জন্য কোন প্রমাণ না দিয়েই যা ইচ্ছা তাই বলে যেতে পারে। কিন্তু যিনি যথার্থ বৈজ্ঞানিক, তিনি অবশ্যই মূল কারণের চরম বিশ্লেষণের মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন ।
শ্রীল প্রভুপাদ: হ্যাঁ, যদি সে পরম উৎস খুঁজে না পায়, তাহলে সে প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানের অনুশীলন করছে না।
ড. সিং: অলৌকিক সম্বন্ধে অবগত হওয়া মানে কি প্রতিদিন যে আমাদের মৃত্যু হচ্ছে, তা জানা? শ্রীল প্রভুপাদ: হ্যাঁ ।
ড. সিং: কিন্তু সাধারণ মানুষ ভেবে দেখে না যে, প্রতিনিয়তই তার মৃত্যু হচ্ছে।
শ্রীল প্রভুপাদ: সেটা তার মূর্খতা। প্রতি মুহূর্তে তার মৃত্যু হচ্ছে, কিন্তু সে মনে করছে, “আমি চিরকাল বেঁচে থাকব।” প্রকৃতপক্ষে, আমাদের জন্মের মুহূর্ত থেকেই আমাদের মৃত্য হতে শুরু করে। এই সমস্যার বিশ্লেষণ করে আমরা বলছি, যেহেতু মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, তাই আমাদের কর্তব্য হচ্ছে সেই মৃত্যুকে রোধ করা কিন্তু তথাকথিত সমস্ত বৈজ্ঞানিকেরা সেই মৃত্যুকে কেবল ত্বরান্বিতই করছে না, তারা তাদের সেই ভুলগুলি সংশোধন করার ব্যাপারে সমস্ত সৎ-উপদেশগুলি গ্রহণ করতেও অনিচ্ছুক।