অভয়চরণ

প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২১ | ৭:০২ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ২৭ আগস্ট ২০২১ | ৭:০২ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 206 বার দেখা হয়েছে

অভয়চরণ

একটি বিশেষ উপহার এক নবজাতক শিশুর জীবন নিয়ে সঙ্কটাপন্ন, তখন এক দম্পতি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভক্তদের শরণাপন্ন হলেন।

অনন্ত বল্লব দাস

যখন আমি জানলাম, আমার পত্নী সন্তান সম্ভবা হয়েছে, তখন এটি আমাদের জন্য খুব আনন্দের সংবাদ ছিল। আমাদের জীবনে এই নতুন আত্মাকে কিভাবে স্বাগত জানানো যায় সে বিষয়ে আবেগপ্লুত হয়ে পড়লাম এবং তখন আমাদের মধ্যে মধুর কিছু অনুভূতির সঞ্চার হতে লাগল। অন্যান্য পিতা মাতারা যে রকম সস্তান আগমনের অধীর অপেক্ষায় থাকে, আমরাও সেই শুভ দিনের প্রতীক্ষায় রইলাম, যখন ডাক্তার এসে বলবে “অভিনন্দন।”
আমরা নিয়মিতই গাইনোকোলজিস্টের সাহচর্যে আছি। তিনি ছিলেন একজন ধার্মিক, মিষ্টভাষী ও ভদ্র মহিলা এবং প্রতিবারই আমরা গর্ভজাত শিশুটির অবস্থা সম্পর্কে কৌতুহলী হয়ে পড়তাম। আড়াই মাস অবস্থায় তিনি একটি স্ক্যান করতে বললেন। স্ক্যান করার পর রিপোর্ট স্বাভাবিক আসে। শিশুটির হার্টবিট শ্রবণ করে আমরা রোমাঞ্চিত হতাম।
পঞ্চম মাসে, ডাক্তার একটি Anamaly (এনামেলি) স্ক্যান করার পরামর্শ দিল। এটি শিশুর এনাটমির আলট্রাসাউন্ড স্ক্যান ছিল। বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয় স্বজনরা তাদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করল যে, কিভাবে প্রথমবারের মতো তাঁদের শিশুদের অবয়ব দেখতে পেয়েছিল এবং এ বিষয়টি আমাদের জন্য বেশ কৌতুহল উদ্দীপক ছিল।
সাধারণত স্ক্যানটি করতে দশ থেকে পনের মিনিট সময় লাগে, কিন্তু ডাক্তার সেটি করেছিল আধ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে। স্ক্যান করার পর তাৎক্ষণিকভাবে কোনো বাক্য বিনিময় ছাড়াই ডাক্তার কক্ষ থেকে প্রস্থান করেন। কি হয়েছে তা জানার জন্য আমি তার পিছু নিলাম। তিনি বললেন শিশুটির একটি মারাত্মক সমস্যা হয়েছে, শিশুটির হার্ট ডানে সরে গেছে। তিনি এই একই স্ক্যানটি একজন বিখ্যাত সিনিয়র কার্ডিওলজিস্টের মাধ্যমে করতে বললেন। আমার এতদিনের চরম সুখকর অনুভূতি দ্রুতই দুর্দশাই পর্যবসিত হল। আমি এ বিষয়টি আমার পত্নীকে জানাইনি এবং পরবর্তী স্ক্যানের ফলাফল পর্যন্ত গোপন রেখেছিলাম ।
শিশুটির অবস্থা জানতে আমি নাছোড়বান্দা ছিলাম, তাই প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমরা এক বিখ্যাত ডাক্তারের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছিলাম। আমাদের পালা যখন আসল তখন আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল, মনের মধ্যে অনেক কিছু ঘোরপাক খাচ্ছিল।
কয়েক মিনিটের স্ক্যানিং শেষে কার্ডিওলজিস্ট জানালেন, “আপনার শিশুর একটি সমস্যা হয়েছে। এই রিপোর্ট নিয়ে দ্রুত গাইনোকোলজিস্টের কাছে যান । তিনি তখন বলবেন কি করা উচিত।”
রিপোর্টটি দেখার পর আমাদের গাইনোকোলোজিস্ট বলল, “দুঃখিত আপনাদের শিশু Congenital Diaphagmatic Hernia (CDH) এ ভুগছে এবং আমি টার্মিনেশন (গর্ভাবস্থার পরিসমাপ্তি নেওয়ার সুপারিশ করছি।
হে, ভগবান! আমরা ভেঙ্গে পড়লাম। আমি ঐ মুহূর্তে কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ নীরবতার পর ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম, “এটি কি ভালো করার কোনো পন্থা নেই?”
ডাক্তার বিষয়টি বিস্তারিতভাবে ব্যাখা করলেন। ডাইয়াফ্রাগামের মধ্যে একটি গর্ত সৃষ্টির কারণে, পাকস্থলী ও ইন্টেস্টাইন বুকের দিকে চলে গেছে, সে সাথে হার্টকে ডানদিকে সরিয়ে দিয়ে বামদিকের ফুসফুসের বৃদ্ধি ব্যাহত করছে। সাধারণত ফুসফুস প্রথমদিকে গর্ভধারণ অবস্থায় বেড়ে উঠে, কিন্তু আমাদের শিশুটির ফুসফুস বাড়ছিল না। শিশুটি ভূমিষ্ট হওয়ার পর শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারবে কিনা সেটা অনিশ্চিত। তাই ডাক্তার পরামর্শ দিলেন, এই ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় টার্মিনেশন নেওয়াই উত্তম ।
সাধারণত CDH এর মতো এই সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয় তৃতীয় ট্রাইমিস্টারের সময় বা কিছু পরে, কিন্তু আমাদের শিশুটির পূর্বেই ধরা পড়ে। ডাক্তার নিশ্চিত ছিল যে, শিশুটির মধ্যে মারাত্মক কোনো জটিলতা রয়েছে।
আমরা ইতোপূর্বে কখনো CDH সম্পর্কে শুনিনি এবং ডাক্তারের ঐ উপদেশ শুনে আমরা আশাহত হয়েছিলাম। যদিও আমরা জানি টার্মিনেশন বা গর্ভকে নষ্ট করার ব্যাপারটি পাপকর্ম, আমরা তখন বুঝতে পারছিলাম না, এরকম ভীতিপ্রদ পরিস্থিতিতে কি করব। তবুও আমরা ডাক্তারকে বললাম, আমরা কোনোভাবেই এই পাপকর্ম করতে প্রস্তুত নই ।
ডাক্তার ধৈর্যশীল হয়ে দৃঢ়ভাবে উত্তর দিলেন, “আমি আপনার সাথে একমত, তবে শিশুটি বাঁচানো নাও যেতে পারে। অথবা কয়েক ঘন্টা, দিন কিংবা কয়েক মাস বাঁচিয়ে রাখা যেতে পারে। এর জন্যে অনেক ব্যয়বহুল সার্জারি করতে হবে। শিশুটির জীবন টিকিয়ে রাখার ব্যাপারটি খুব একটা বাস্তবসম্মত নয়। আপনারা এখনও যুবক-যুবতী, এই ধরনের ধারণা আপনাদের জন্যে প্রথম এবং আপনারা চাইলে আরেকটি সন্তানের চেষ্টা করতে পারেন।”
এত সব প্রশ্ন সত্ত্বেও আমরা কিছুক্ষণের জন্য কোনো কথায় বলতে পারলাম না। আমি এটুকু বললাম যে, তার কথাগুলো আমাদের বোধগম্য হয়েছে এবং আমরা অনুরোধ করলাম, আমাদের কিছু সময় দেওয়ার জন্য।
ডাক্তার বললেন-“আমি আপনার উদ্বিগ্নতা উপলব্ধি করতে পেরেছি। যদি আপনি সন্তান নষ্ট করার সিদ্ধান্ত নেন, তবে দু’দিনের মধ্যেই আমাকে জানাতে হবে, কারণ সন্তানটির বয়স ইতোমধ্যেই চার মাস হয়ে গেছে এবং আর বেশি দেরী করলে মা-সন্তান দুজনই বিপদাপন্ন হবে।”
ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমরা বাড়ি ফিরে গেলাম । আমি পত্নীকে সমবেদনা জানাতে গিয়ে ব্যর্থ হই। সে শিশুটির বাঁচা-মরার ব্যাপারটি ভেবে কষ্ট পাচ্ছিল । তার গর্ভাবস্থার ব্যাপারটিই দুর্দশাময় হয়ে উঠল ৷ পিতা-মাতা হওয়ার খুশির সংবাদটি তখনই পরিসমাপ্তি ঘটল। বৈষ্ণবী তখনও সন্তানের নড়াচড়া অনুভব করছিল। আনন্দের বিষয়টি তার জন্য নিরানন্দ হয়ে গেল ।
আমি এভাবে তার প্রতি সমবেদনা জানানোর প্রচেষ্টা করছিলাম। একটি পরম শিক্ষা প্রদানের জন্য কৃষ্ণের একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। আর তাই তিনি আমাদের এরকম পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেছেন। এটি আমাদের পূর্বকর্মের ফল এবং আমাদের সেই ফল ভোগ করতেই হবে, যদি কৃষ্ণ চান তো আমাদের শিশুটির সুরক্ষা হবেই। কেউ তার ক্ষতি করতে পারবে না; যদি কৃষ্ণ তাকে নিয়ে যেতে চান, তবে কেউই তার সুরক্ষা প্রদান করতে পারবে না।
আমি সবসময় তাকে বলতাম, জীবন এবং শিক্ষকের মধ্যে পার্থক্য হল, একজন শিক্ষক প্রথমে শিক্ষা দেয় এবং পরে পরীক্ষা নেয়। কিন্তু জীবন আগে পরীক্ষা নেয় এবং তারপর শিক্ষা দেয়। অতএব, আমাদের সর্বদা শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত।

সঠিক দিক-নির্দেশনা ও অনুসন্ধান

আমাদের কমিউনিটিতে ভক্তদের জন্য রয়েছে কাউন্সিলর পদ্ধতি, যারা বছরের পর বছর ধরে কৃষ্ণভাবনার সান্নিধ্যে রয়েছেন এবং তাঁদের অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা যা তাঁরা তাঁদের জ্যেষ্ঠ ভক্তদের কাছ থেকে লাভ করেছে, তা অন্যদের সঙ্গে বিনিময় করেন। যারা পদ্ধতিগতভাবে কৃষ্ণভাবনা সম্পর্কে জানতে এবং অনুশীলন করতে আগ্রহ ভরে বাসনা করে তারাই এ শিক্ষা লাভ করতে পারে।
আমরা আমাদের কাউন্সিলরের সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলাম। যদিও এটি কঠিন হতে পারে, তবুও আমরা তার দিক নির্দেশনা গ্রহণ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলাম। কারণ কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুসরণ করলে কৃষ্ণ সন্তুষ্ট হবেন। সময় নিয়ে আলোচনা করার পর, সিদ্ধান্ত নিলাম তিনি যাই বলছেন আমরা তাই করব।
সব শোনার পর আমাদের উপদেষ্টা অবাক হয়ে সঠিক সমাধানের জন্য সময় চাইলেন। আধ ঘন্টা পর তিনি আমাদের ডেকে দৃঢ় বিশ্বাস ও স্বচ্ছ উপলব্ধি সহকারে মধুরভাবে ব্যাখা করলেন, কেন আমাদের গর্ভ নষ্ট করা উচিত হবে না। আমি তখন ডাক্তারের পক্ষাবলম্বন করে বিভিন্ন কারণ দাঁড় করালাম, কিন্তু তিনি এসব কারণ অজস্র শাস্ত্রীয় উপলব্ধি ও যারা ইতোমধ্যে এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল সে সমস্ত ভক্তদের দৃষ্টান্ত প্রদর্শনের মাধ্যমে বিশ্বাস জুগিয়েছিলেন। পরিশেষে আমরা খুশি মনেই গর্ভাবস্থা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম ।
শাস্ত্রীয় দর্শন প্রদানের ক্ষেত্রে আমাদের কাউন্সিলর ও অন্যান্য জ্যেষ্ঠ ভক্তরা পূর্ণ সহায়তা প্রদান করেছিলেন। তাঁরা বলেন, এটি কৃষ্ণেরই পরিকল্পনা এবং এতে আমরা কেউই হস্তক্ষেপ করতে পারি না। কেউ জানে না যে, আসলে শিশুটির ভবিষ্যত কি হবে?
এটি আমাদের জন্য ভগবানের বিশেষ একটি পরিকল্পনা এবং তাই আমাদের কর্মানুসারে আত্মা এই গর্ভটি নির্ধারণ করেছেন। আমাদের কর্তব্য হল, কৃষ্ণ কর্তৃক প্রেরিত সেই আত্মাটির যত্ন গ্রহণ করা। শিশুটি কয়েক মাস, বছর, সপ্তাহ, দিন কিংবা মিনিট পর্যন্ত বেঁচে থাকবে, কি থাকবে না এটি নিয়ে না ভেবে, আমাদের সর্বোচ্চ সক্ষমতা ব্যবহার করে শিশুটিকে কৃষ্ণভাবনা প্রদান করা উচিত। এটি সকল পিতা মাতার কর্তব্য।
আমরা সৌভাগ্যবান যে, এরকম অনেক ভক্তদের কাছ থেকে সুন্দর সুন্দর দিক নির্দেশনা লাভ করেছি, যার জন্য আমরা তাঁদের কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। আমাদের গুরুদেব, শ্রীমৎ রাধানাথ স্বামী তখন হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থান করছিলেন। তিনি আমাদেরকে এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে আশা মানসিক শক্তি ও সঠিক মনোভাব পোষন করার বিষয়ে লিখেছিলেন। আমাদের জন্য ভগবানের কাছে তিনি প্রার্থনা নিবেদন করবেন বলে জানিয়েছিলেন। কিভাবে আমরা এ জড়জগতে কঠিন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হই সেই বিষয়ের ওপর অন্তদর্শন প্রদান করেছিলেন। এই প্রতিবন্ধকতাসমূহ সহিষ্ণুতা ও সততার সাথে অতিক্রম করার মাধ্যমে এবং একনিষ্ঠভাবে ভগবানের আশ্রয় গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের ওপর আশীর্বাদ বর্ষিত হবে। ভগবানের বাণীসমূহ সমুদ্রে নিমজ্জিত একজন ব্যক্তির জন্য একটি দড়ির মত। এদিকে আমাদের পিতা-মাতাও এই টার্মিনেশনের বিপক্ষে ছিলেন, কিন্তু তারা আমরা কি করি তা দেখতে চেয়েছিলেন। তারা এই পরিস্থিতিকে ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করতে উৎসাহিত করেছিলেন।
এখন আমরা সিদ্ধান্ত সম্পর্কে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ডাক্তারের কাছে ফিরে গিয়ে বললাম- “আমরা গর্ভাবস্থা অব্যাহত রাখব। এজন্যে আপনার আশীর্বাদ ও সহায়তা প্রয়োজন।”
শিশুর ঝুঁকি সত্ত্বেও আমাদের সাহসী সিদ্ধান্ত দেখে ডাক্তারও হতবাক হয়ে গেলেন। তিনি আবারো আমাদের বিভিন্নভাবে বোঝালেন। আমরা এর মাধ্যমে ডাক্তারকে কৃষ্ণভাবনা সম্পর্কে বলার সুযোগ পাই। আমি কর্মের আইন ও কেন ভ্রুণহত্যা পাপ এ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করলাম।
তিনি বৈষ্ণবীয় দর্শন জেনে খুশি হয়ে বললেন, “ভগবানের ওপর আপনাদের অগাধ বিশ্বাস রয়েছে। আমিও ভগবানের কাছে সর্বোত্তম ফলাফলের জন্য প্রার্থনা করব।

সেই মুহূর্তটির আগমন

শিশুটির বয়স নয় মাস সফলভাবে অতিক্রান্ত হয়। শিশুটির আগমনের এক দিন পূর্বে আমার পত্নীকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। আমাদের গাইনোকোলজিস্ট নিওন্যাটোলজিস্টদের প্রতিটি পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করে এবং অন্যান্য ডাক্তাররা ভেন্টিলেটর, অক্সিজেন এবং সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে প্রস্তুত হয় ।
আমরা ডাক্তারের কাছে মিনতি করলাম, যাতে প্রসব কক্ষে ‘হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্রের’ একটি রেকর্ডিং বাজানোর অনুমোদন দেওয়া হয়। অনুমোদন দেওয়া হলে এটিই বৈষ্ণবীকে শক্তি প্রদান করবে। আমার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা, আমার মাতা ও এক ভক্ত দম্পতি আমার সাথে থেকে নৈতিক সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন। সবকিছু যাতে ভালোভাবে হয় সেজন্যে, আমি প্রার্থনা করলাম, জপ করলাম এবং আশাবাদী হলাম।
এক ঘন্টা পর, নিওন্যাটোলজিস্টরা ঐ কক্ষ থেকে একটি ইনকিউবেটরে করে শিশুটিকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। আমি দেখলাম শিশুটির শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। অনেক মাস যে, চোখের জল আমি ধরে রেখেছিলাম এখন আর তা পারিনি। আমি যখন দেখলাম ইনকিউবেটরে ভিতরে ছোট শিশুটির শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, আর নিজের জীবন নিয়ে সংগ্রাম করছে, আমার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।
এদিকে বৈষ্ণবী খুব আগ্রহভরে প্রতীক্ষা করছে কখন তার নবজাতক শিশুকে বাহুযুগলে বন্ধী করবে, কিন্তু তা আর হয়নি। শুধু দূর থেকে শিশুকে দেখতে পেলেন। তখন শিশুটিকে অক্সিজেন এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেওয়া হল। শিশুটির জন্মের মুহূর্ত থেকে তাকে কড়া নজরদারীর মধ্যে রাখা হয়েছিল। ডাক্তাররা আমাদের বলছিল যে, এই মুহূর্তে প্রথম ক্রন্দনটি গুরুত্বপূর্ণ, কেননা শিশুটিকে নিজেই নিজের শ্বাস নিতে হবে। যেই মাত্র আমার পত্নী সন্তানের কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল তাঁর চোখের জল অপ্রতিরোধ্য হল এবং এর মাধ্যমে তাঁর মাঝে আশার সঞ্চার হল ।
পরবর্তীতে পুত্র শিশুটিকে নিওন্যাটাল ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট (NICU) এ নেওয়া হল। আমি তখন বর্তমান অবস্থা দেখার জন্য ছুটে গেলাম। সে তখনও ডেলিভারী কক্ষে ছিল। অনেকক্ষণ পর সে বেরিয়ে আসল।
সে আমার হাত ধরে জিজ্ঞেস করল “শিশুটি কেমন আছে?” চোখের জল নিয়ন্ত্রণ করে আমি বললাম, “সে ভালোই আছে এবং সে দেখতে হয়েছে আমার মতো।” আমার পত্নী চেয়েছিল, সন্তান দেখতে আমার মতোই হবে। সে খুশি হয়েছিল, কিন্তু NICU এর মধ্যে শিশুর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে শুনে বিষন্ন হয়ে গেলো।

প্রতীক্ষা

NICU এর ডাক্তাররা বলছিল শিশুটি শতকরা দশ’ভাগ নিজে নিজে, আর বাকি নব্বই’ভাগ ডেন্টিলেটরের সহায়তায় শ্বাস প্রশ্বাস চালাচ্ছে। একবার ডেন্টিলেটরের সহায়তা পঞ্চাশ ভাগে আসলে তারা তাকে সার্জারির জন্য নিয়ে যাবে। কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে NICU তে গভীর পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখা হয়েছিল।
সেখানে শুধু আমি আর আমার পত্নী ছিলাম। ঐভাবে আমাদের সন্তানকে দেখার ব্যাপারটি অসহনীয় ছিল, কিন্তু তবুও আমরা তার সাথে থাকতে চেয়েছিলাম। বৈষ্ণবীকে রিকোভারি ওয়ার্ডে নেয়া হল। প্রতিদিন সন্ধ্যায় অনেক ভক্তের আনাগোনা হয়েছিল। তাদের সঙ্গে কৃষ্ণ কথা আলোচনার মাধ্যমে এ উদ্বিগ্নতা অতিক্রমের জন্য প্রচুর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল ।
এক সপ্তাহ পর পেডিয়াট্রিক সার্জনরা অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নিল । শিশুটির যে কোনোভাবেই একটি স্থিতি আসলে তারা আর অপেক্ষা করেন নি। ডাক্তাররা আমাদের বলল, ভগবানের কাছে প্রার্থনা করার জন্য। তারা তাদের সর্বোচ্চ উজার করে দেবে। ভক্ত, বন্ধু ও আত্মীয় স্বজনদের রেখে আমি গভীরভাবে পবিত্র নাম জপে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে মনোনিবেশ করলাম। এছাড়া আমার আর অন্য কোনো উপায় ছিল না।
দুই’ঘন্টা পর সার্জন এসে বলল, “দুঃশ্চিন্তা করার কোনো দরকার নেই, শিশুটি ভালোই আছে। গর্ভধারনের প্রথম দিকে CDH ধরা পড়ল, আমরা ভেবেছিলাম ওর ফুসফুস ভালোভাবে বেড়ে উঠেনি। কিন্তু এখন ওর ফুসফুস নিয়ে আমরা যা ধারণা করেছিলাম তার চেয়েও ভালো অবস্থানে আছে। কিভাবে এটি হল তা দেখে অবাক হচ্ছি।”
আমি তা শুনে হতভম্ব ও নির্বাক হয়ে গেলাম এবং সন্তানকে দেখার জন্য আগ্রহ আরো বেড়ে গেল। সার্জারীর পর শিশুটিকে পুণরায় NICU তে অপারেশন পরবর্তী পরিচর্যার জন্য নেওয়া হল। সে NICU তে দু’সপ্তাহ ধরে ছিল এবং হাসপাতালে প্রায় এক মাস ছিল। প্রতিদিনই আমাদের অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল। যখন দিনের পর দিন তার শারীরিক অগ্রগতি সাধিত হল, একসময় অবশেষে তার ছাড়পত্র দেওয়া হলো।
এরকম কঠিন পরীক্ষা দিতে আমরা অপ্রস্তুত ছিলাম। যদিও ঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নিতে পেরে সন্তুষ্ট ছিলাম। আসলে এ ছাড়া আমাদের অন্য কোনো উপায়ও ছিল না এবং যা অদৃষ্টে আছে তাই হতে দিচ্ছিলাম। আমাদের একটি মাত্র উপায় ছিল প্রার্থনা, প্রার্থনা আর প্রার্থনা করে যাওয়া। মাঝে মাঝে আমরা দ্বিধাগ্রস্থ হতাম কি জন্যে প্রার্থনা করব? আর তখন সবকিছু কৃষ্ণ ও গুরুদেবের হাতে ছেড়ে দিতাম এবং আমরা যা ভোগ করেছি তা গুরু, ভক্তবৃন্দ ও অন্যান্য শুভাকাঙ্ক্ষীদের হৃদয় গভীর প্রার্থনার সঙ্গে তুলনা করা যাবে না।
বর্তমানে আমরা এক সন্তানের সুখী পিতা-মাতা, যে কিনা ভগবানের কৃপায় অন্য সব সুস্বাস্থ্যবান শিশুর মতোই একজন। আমরা এটি বলতে পারি যে, আমাদের সন্তান হল প্রার্থনা দিয়ে গড়া। প্রার্থনা কখনো ব্যর্থ হয় না; আমরা প্রাপ্য থেকেও বেশি পেয়েছি। ভক্তসঙ্গ ও গুরুদেবের সঙ্গ ছাড়া আমাদের জীবনকে কল্পনাও করতে পারি না, যাদের সহায়তা ছাড়া আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম না।
একসময় আমাদের গাইনোকোলজিস্টের সঙ্গে দেখা করতে গেলে, তিনি শিশুটিকে দেখে অত্যন্ত খুশি হন। জল ভরা চোখ নিয়ে তিনি বললেন, “ভগবান আছেন, আর ভগবান তার ভক্তদের সুরক্ষা করবেন।” আমাদের গুরুদেব শিশুটির ওপর আশীর্বাদ বর্ষন করে নাম দিল অভয়চরণ, যা একটি বিশেষ উপহার কেননা এই নামটি ছিল শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের শৈশবের নাম।
আমার পত্নী ও গুরুদেব, জ্যেষ্ঠ ভক্তবৃন্দ, পরিবারের সদস্যবৃন্দের উদ্দেশ্যে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি যারা আমাকে পরিচালনা ও সহযোগিতা করেছিলেন। আমাদের সন্তান হল আমাদের জন্য একটি বিশেষ উপহার এবং যে সমস্ত ভক্ত, আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবরা নিরবচ্ছিন্নভাবে তার জন্য প্রার্থনা করেছিলেন তাদেরকে ধন্যবাদ জানানোর কোনো ভাষা আমাদের নেই। শুধুমাত্র এই প্রার্থনাগুলোর কারণেই অভয়চরণ এমন এক বড় যুদ্ধে সংগ্রাম করতে সমর্থ হয়েছিল। আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি, শ্রীল প্রভুপাদের কাছে, যিনি কৃষ্ণভাবনায় কিভাবে পাপ কর্মহীন পবিত্র একটি জীবন লাভ করা যায়, সেই বিষয়ে শিক্ষা প্রদান ও একটি মহৎ সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে আমাদের জীবনে এক বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন।

অনস্ত বল্লভ দাস ও তার পরিবার ব্যাঙ্গালোরে, ইস্কন শ্রী জগন্নাথ মন্দিরের ভক্ত গোষ্ঠিদের সঙ্গে কৃষ্ণভাবনা অনুশীলন করেন। 


 

জানুয়ারি-মার্চ ২০১৫ ব্যাক টু গডহেড
সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।