এই পোস্টটি 277 বার দেখা হয়েছে
‘অবতার’ একটি হলিউড সিনেমা যা আমেরিকাতে দুইশ’ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিত হয়েছিল। এই চলচ্চিত্র নির্মাতা জেমস কামেরুন তার বোধ অনুযায়ী এই শব্দের ব্যাখ্যা দেন “অবতার হিন্দু ধর্মের একটি শব্দ যার অর্থ হলো কোনো স্বর্গীয় ব্যক্তিত্বের প্রকাশ যেমন শিব। তাই এই চলচ্চিত্রটি হলো, একটি জীবন্ত মানুষ যে তার চেতনাকে সেই দেহে স্থাপন করতে পারে, এই আপাত কঠিন ধারণাটিকে বোঝানোর প্রয়াস। একই সাথে আমরা এই বিষয়টিকে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগও গ্রহণ করতে পারি। প্রধানত কৃষ্ণ (বিষ্ণু), যিনি চিন্ময় জগত থেকে এই ভৌতিক জগতে অবতরণ করেছিলেন। এখানে তাঁর আবির্ভাবকে অবতার বলা হচ্ছে। সংস্কৃত শব্দ অবতার (যিনি অবতরণ করেন) ইংরেজীতে যাকে প্রায়ই বলা হয় কারনিস (মানবদেহ গ্রহণ)। এটি ভাবা মারাত্মক ভ্রম হবে যে, কৃষ্ণ মানব দেহ গ্রহণ করেছেন যা ভৌতিক উপাদানে গঠিত। ভগবদ্গীতায় ভগবানের চিন্ময় তত্ত্ব এবং ভৌতিক উপাদান তত্ত্বের পার্থক্য সম্বন্ধে খুব প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা আছে। ভৌতিক বস্তু যেমন ক্ষিতি, অপ, মরুৎ, তেজ ও ব্যোম এ সকলই অস্থায়ী প্রকৃতির, বিনাশশীল। কৃষ্ণর নিজস্ব গুণ পরা-প্রকৃতি, একে দেখা যায় না, নিত্য এবং অভ্রান্ত। “যখন শুধুমাত্র ভগবান কৃপা করে অবতরণ করেন তখন অদৃশ্য দৃশ্যমান হয়।”
কামেরুন আরো বলেন, “সেটি আমার কাছে ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য, কারণ এটি বাহ্য অবতার নয় যার অন্য এক দ্বিতীয় স্বত্ত্বা (সাইবার দুনিয়াতে ওয়েবসাইট কৃত বাহ্যিক অস্তিত্ব) অথবা কোনো কার্যের জন্য অভিনয় করা হচ্ছে এমন।
এটি একটি জীবন্ত, শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া জৈব দেহ। তাই সে মানবিক দেহ নিয়ে নিদ্রা যায় এবং অবতার দেহে জাগ্রত হয়। সে যখন দিনের শেষে নিদ্রা যায় তখন তার মানবিক দেহ জাগ্রত হয়। তখন আপনি নিদ্রা যান কেননা আপনার বিশ্রামের প্রয়োজন আছে।’
খুব ভাল, বিনোদন শিল্পের এই আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা ভালো, এখন বৈদিক শাস্ত্রের ব্যাখ্যা থেকে এর সত্যতা যাচাই করা যাক।
কতগুলি অবতার আছেন ?
ভগবানের অসংখ্য অবতার। ভগবান হিসাবে তাঁর প্রকৃত সত্ত্বা একই থাকে। কিন্তু তাঁর অবতারের সংখ্যা অসংখ্য। ভারতবর্ষে দশটি জনপ্রিয় অবতারের কথা লেখা হয়েছে এবং তাঁদেরকে দশাবতার বলা হয় এবং বিশেষরূপে তাঁদের আরাধনা করা হয়। তাঁরা হলেন
১। মৎস্য: ভগবানের বিশালাকার মৎস্য রূপ।
২। কূর্ম: কচ্ছপ রূপ।
৩। বরাহ: শুকর রূপ।
৪। শ্রীনৃসিংহ: অর্ধমানব অর্ধসিংহ রূপ।
৫। পরশুরাম: কুঠার হস্তে সন্ন্যাসী রূপ।
৬। বামন: বেঁটে ব্রাহ্মণ বালক রূপ।
৭। শ্রীরামচন্দ্র: অযোধ্যার রাজা রূপ।
৮। শ্রী বলরাম: ভগবান কৃষ্ণের ভ্রাতা রূপ।
৯। বুদ্ধ: যিনি নাস্তিকদের ভ্রমিত করেছিলেন।
১০। কল্কি: যিনি কলি যুগের শেষে সমস্ত পতিত জীবদের নিধন করবেন।
ভগবানের অবতার ধারণের কারণ কি?
শ্রীল প্রভুপাদ ভগবদ্গীতার (৪/৭) এর তাৎপর্যে ব্যাখ্যা করেছেন। ‘বেদের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবানের নির্দেশ অনুযায়ী ধর্মের স্থাপনা করা। গীতার শেষে ভগবান স্বয়ং নির্দেশ দিচ্ছেন সর্বোচ্চ ধর্মই হচ্ছে তাঁর শরণাগত হওয়া আর অন্য কিছু নয়।
বৈদিক নীতি একজনকে তাঁর শরণাগত হতে প্রভাবিত করে কিন্তু যখন এই নীতিগুলি অসুরদের দ্বারা প্রবল বিরোধীতার সম্মুখীন হয় তখন ভগবান অবতীর্ণ হন। শ্রীমদ্ভাগবতে আমরা দেখতে পাই যে, ভগবান বুদ্ধ শ্রীকৃষ্ণের অবতার এবং তিনি তখন অবতীর্ণ হয়েছিলেন যখন জড়বাদ ছিল প্রবল এবং জড়বাদকে বেদের বর্ণিত ব্যাখ্যা বলে প্রচার করা হচ্ছিল। যদিও বেদে প্রাণী উৎসর্গের কিছু বিধান পাওয়া যায় কিন্তু আসুরিক প্রবৃত্তির মানুষেরা এই ব্যাপারে প্রকৃত নীতিকে অমান্য করে নির্বিকারে প্রাণী হত্যা করছিল। ভগবান বুদ্ধ এই নৃশংস কার্যকে বন্ধ করার জন্য এবং বেদে বর্ণিত অহিংস নীতির প্রতিষ্ঠা করার নিমিত্তে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সুতরাং প্রত্যেক অবতারের অথবা ভগবানের প্রকাশের বিশেষ উদ্দেশ্য থাকে যা প্রামাণিক শাস্ত্রে ব্যাখ্যা করা আছে। তাই শাস্ত্রস্বীকৃতি ব্যতীত কাউকেই অবতার বলা যায় না। এটা সত্য নয় যে, ভগবান শুধুমাত্র ভারতবর্ষেই অবতীর্ণ হন। তিনি তাঁকে যেকোনো স্থানে ও যেকোনো সমওয় ইচ্ছানুযায়ী প্রকাশ করতে পারেন। তাঁর প্রত্যেক অবতারে তিনি স্থান, কাল, পাত্র অনুযায়ী ধর্মের উপদেশ প্রদান করেন। কিন্তু প্রত্যেক ক্ষেত্রে লক্ষ্য একই থাকে মানুষকে ভগবত চেতনা সম্পন্ন করা এবং ধর্মীয় নীতির উপর শ্রদ্ধাবান রাখা। কখনো কখনো তিনি স্বয়ং অবতীর্ণ হন বা তিনি তাঁর মনোনীত প্রতিনিধিকে তাঁর পুত্র বলে, কিংবা ভৃত্যরূপে অথবা স্বয়ং কোন আচ্ছাদিত রূপে পাঠান।
আমরা কি সবাই অবতার হতে পারি?
কিছু বিতর্ক আছে যে, যেকোনো এবং সমস্ত দেহরূপী বস্তুকেই অবতার আখ্যা দেওয়া যায়। বহু সংখ্যক ‘ধর্মগুরু’ ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গাতে নিজেদেরকে অবতার বলছে। এসমস্ত তথাকথিত ভগবানের মধ্যে কিছু আছে যারা অতীন্দ্রিয়বাদী, কেউবা চমৎকারী এবং অনেকেই রাজনীতিবিদ। কিন্তু এদের কাউকেই বেদের দ্বারা অনুমোদন দেওয়া হয়নি। তারা শুধু নিরাকার অসীম সত্য সীমাহীন বস্তুরূপে প্রকাশিত হয়। এই মিথ্যা ধারণাকে প্রকাশ করে এবং বলে মানুষরূপে আত্মপ্রকাশকারী তুমি ও আমি সকলেই ভগবান। তারা এই রূপে বোঝায় যেহেতু প্রত্যেক ভগবানের বিভিন্ন ধর্ম (প্রকৃতধর্ম) সম্বন্ধে বিভিন্ন মত এবং এটিই প্রকৃত সত্য যে, সেই সমস্ত ভগবানের গন্তব্য একই লক্ষ্যে। এই ধারণা অন্ধকারময় এবং অব্যবহারিক। কেউ একজন নিজেকে অবতাররূপে জাহির করতে পারে কিন্তু তাকে প্রমাণ করতে হবে যে, প্রকৃত ভগবানের ন্যায় সে সমস্ত অসাধ্য সাধন করতে পারে। যখন কোনো সাধারণ ব্যক্তি তাঁকে ভগবান বলে ঘোষণা করে এবং বলে যে, তাঁর কর্মই বেদের ধর্ম তখন সেটিকে সনাতন ধর্মীয় রীতিনীতির ওপর আঘাত বলে মনে করা হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাই ঘোষণা করেছেন “ভক্তদেরকে উদ্ধার করার নিমিত্তে, অসুরদেরকে ধ্বংস করার নিমিত্তে এবং ধর্ম পুনঃস্থাপন করার উদ্দেশ্যে আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হব।” (ভগবদ্গীতা ৪/৮)
আধ্যাত্মিক জগত
চলচ্চিত্রটির ফলতঃ জগৎ অবাস্তব কিন্তু সেখানে আরেকটি বাস্তব জগতও বর্তমান যা কল্পনার সুখরাজ্য অপেক্ষা অধিক সুন্দর এবং আমরা সকলেই সেখানে যেতে পারি। সেটিই আধ্যাত্মিক জগত, ভগবানের রাজ্য, আমাদের প্রকৃত গৃহ যা বৈদিক শাস্ত্রতে উজ্জ্বলভাবে বর্ণনা করা আছে। আধ্যাত্মিক জগতের অধিবাসীদের সম্বন্ধে বর্ণনা করা হয়েছে যে, তারা উজ্জ্বল আকাশনীল বর্ণ সমন্বিত। তাদের আঁখিযুগল কমলের ন্যায়, তাদের বসন পীত বর্ণের এবং অঙ্গ সৌষ্ঠব অতি আকর্ষণীয়।
তারা সকলেই নব যৌবন সম্পন্ন, প্রত্যেকের চারটি করে হস্ত বর্তমান, তারা প্রত্যেকেই মনিমুক্তার অলংকারে সুসজ্জিত এবং সকলেই দীপ্যমান। তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রবাল এবং হীরকের মতো দ্যুতিমান। মস্তকে মালা দ্বারা শোভিত, প্রস্ফুটিত কমলের ন্যায় উজ্জ্বল, কেউ কেউ আবার কর্ণ কুণ্ডল দ্বারাও ভূষিত। এটি বৈদিক শাস্ত্রতে বিস্তার বর্ণনার এক ক্ষুদ্র অংশমাত্র।
আমাদের তুরীয়বাদীদের মধ্যে কেউই এই বর্ণনার ওপর ধ্যান করে অবসাদ বা আত্মঘাতীমূলক কোনো অভিজ্ঞতা লাভ করেননি। তাই আধ্যাত্মিক জগত সম্বন্ধে প্রামাণিক বর্ণনা এবং তা অধ্যয়ন আমাদের প্রকৃত অবতারের রাজ্যকে আবিষ্কার করার উৎসাহ প্রদান করে এবং যে নিজের সম্বন্ধে অশুভ ক্রিয়াকলাপ প্রকাশ করে তাকে কখনোই নয়।