এই পোস্টটি 190 বার দেখা হয়েছে
শ্রীজগন্নাথ পুরী মন্দিরের আর একটি অন্যতম উৎসব হল নবকলেবর উৎসব। তবে এটি প্রতি বৎসরের উৎসব নয়। সাধারণতঃ প্রতি বারো বৎসর পরপর এই নবেকলেবর উৎসব হয়। শেষ নবকলেবর উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিগত ১৯৯৬ সালের ১৭ জুলাই। পুরানো বিগ্রহের বদলে শ্রীশ্রীজগন্নাথ, বলদেব, সুভদ্রাদেবী ও সুদর্শনের নতুন দারুবিগ্রহ অধিষ্ঠিতকরণের নামই নবকলেবর উৎসব। কলেবর অর্থ দেহ। অর্থাৎ নতুন দহে ধারণ উৎসব। যে বৎসর এই নবকলেবর উৎসব হবে, সে বৎসর আগে থাকতেই বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন নিমগাছের কাঠ সংগ্রহ করে শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের কলি বৈকুণ্ঠ নামক স্থানে আনা হয়। সেখানে সতর্কতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে গোপনে বিগ্রহ নির্মাণের পর তাঁদের মন্দিরের গর্ভগৃহের রত্নসিংহাসনে অধীষ্ঠিত করা হয়। রত্নসিংহাসনে প্রতিষ্ঠার আগে অবশ্য পুরানো বিগ্রহের ‘ব্রহ্ম’ নতুন বিগ্রহে স্থানান্তরিত করা হয় । শ্রীবিগ্রহের অঙ্গে এই ‘ব্রহ্ম’ স্থানান্তরের জন্য একটি ছোট গর্ত থাকে। যে বৎসর নবকলেবর উৎসব সেই বৎসরেই পবিত্র আষাঢ় মাসের অমাবস্যার দিন কয়েকজন অভিজ্ঞ ও বয়োজ্যেষ্ঠ পুরোহিত এই ‘ব্রহ্ম’ স্থানান্তর বা পরিবর্তনের সেবা পালন করে থাকেন। জনশ্রুতি রয়েছে, যে কয়েকজন পুরোহিত এই ‘ব্রহ্ম’ পরিবর্তনের সেবা পালন করেন তাঁরা এরপর আর বেশীদিন এই ধরাধামে জীবিত থাকেন না। অনেকের মনে হয়ত প্রশ্ন আসতে পারে যে এই ‘ব্রহ্ম’ যা নতুন বিগ্রহে স্থানান্তর করা হয়, সেটি কি? এই ‘ব্রহ্ম’ হল এক অমূল্য শালগ্রামশিলা যা শ্রীজগন্নাথের দারুবিগ্রহের মধ্যে লুকানো অবস্থায় থাকে। এই পবিত্র শালগ্রামশিলা পুরানো বিগ্রহ বের করে নতুন দারুবিগ্রহ স্থানান্তরিত করা হয়। ভাগবতপুরাণ, মৎসপুরাণ ও অগ্নিপুরাণে ভগবানের দারুবিগ্রহ নির্মাণের বিধান রয়েছে। যেহেতু দারু একটি ভঙ্গুর পদার্থ, তাই মনে হয় এই ‘নবকলেবর’ উৎসবের মধ্য দিয়ে ভগবানের দারুবিগ্রহ নতুন করে নির্মাণ করে এই পরিবর্তনের ব্যবস্থা। পরমেশ্বর ভগবান জগন্নাথ, বলদেব, সুভদ্রাদেবী ও সুদর্শনের দারু বিগ্রহসমূহ নির্মিত হয় নিম কাঠে। যে সে নিম গাছের কাঠ হলে হবে না। এর অবশ্যই কিছু বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে। সেই বৈশিষ্ট্যগুলি এরকম –(১) সেই নিম গাছের কাণ্ডটি কম করে বার ফুট হতে হবে। (২) পবিত্র শঙ্খ, পদ্ম, গদা ও চক্র চিহ্নের অন্তত যে কোন দুটি চিহ্ন বা ছাপ থাকতে হবে সেই কাণ্ডে। (৩) সেই নিম গাছটির রঙ হবে কালো। (৪) গাছটির প্রধান শাখা থাকবে চারটি। (৫) গাছটি থাকবে তিনটি পথের সংযোগস্থলে। (৬) বেলগাছ ও বরুণগাছ দ্বারা গাছটির আশপাশ পরিবেষ্টিত থাকবে। (৭) গাছটি তিনটি পাহাড়ের মদ্যস্থলে থাকবে। (৮) নিমগাছটির কাছে কোন আশ্রম থাকবে। (৯) গাছটির কাছে উই ঢিবি থাকবে। (১০) সেই গাছে কোন পাখির বাসা থাকবে না। (১১) সেই গাছে কখনও বাজ পড়বে না এবং ঝড়ে ডাল পালা ভেঙে যাবে না। (১২) সেই নিম গাছের কাছাকাছি কোন শ্মশান থাকবে। (১৩) কোন নদী বা পুস্করিণীর পাশে থাকবে সেই নিমগাছটি। (১৪) সেই নিম গাছের নীচে থাকবে গোখরো সাপের বাসা। এই ১৪টি লক্ষণের মধ্যে অন্ততঃ পাঁচটি লক্ষণ মিললে সেই নিমগাছটিকে ভগবানের বিগ্রহ নির্মাণের জন্য নির্বাচিত করা যেতে পারে। এরকম নিমগাছ খুঁজে পেলে তিনদিন ধরে সেই গাছের নীচে যজ্ঞ করা হবে শ্রীনৃসিংহদেবের উদ্দেশ্যে। এরপর নবকলেবরের জন্য নির্বাচিত সেই গাছকে গরুর গাড়ীতে করে শ্রীজগন্নাথ মন্দিরে কৈলি বৈকুণ্ঠে নিয়ে আসা হয়। সেখানে নির্মাণ মণ্ডপে যারা দারু বিগ্রহ নির্মাণ করেন, তাদের বলা ‘বিশ্বকর্মা’। এদের দুইতাপতি সেবকও বলা হয়।
নতুন দারু বিগ্রহকে যেমন মন্দিরের রত্নসিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা হয়, তেমনি পুরানো দারু বিগ্রহসমূহকে কৈলি বৈকুণ্ঠেই রেশমী বস্ত্র ও তুলোর বালিশে শুইয়ে সমাধি দেওয়া হয়।